• সর্বশেষঃ

    কেমন ছিলো ১৯৭১ - এর পাক অধিকৃত বাংলাদেশের দূর্গাপূজা?

    রাজশাহী বিশিষ্ট সংস্কৃতজন প্রয়াত ওবায়দুর রাহমান এর সম্পাদনায় মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে প্রকাশিত পত্রিকা 'বাংলার কথা'য় সেবারের দূর্গাপূজা নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিলো।

    "বাংলাদেশে এবারের দূর্গাপূজা" – শিরোনামে সত্যপ্রিয় রায়ের সেই আর্টিকেলটি হুবহু তুলে ধরা হলোঃ


    বাংলাদেশে এবারের দূর্গাপূজা
    – সত্যপ্রিয় রায়
    (নাটোর থেকে)

    বাংলাদেশে শরৎ এলো। শরতে ঢাকের বাদ্য "মা দূর্গার আগমনি বার্তা নিয়ে এতকাল বাঙালীর মনে সাড়া জাগাত। এবারেও শরৎ এসেছে বাংলাদেশের সেনালী রদ্দুরে চার দিক ঝলমল করছে। কিন্তু বাংলাদেশে ঢাকের বাদ্য শোনা যাচ্ছে না।

    ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশের স্বাভাবিকতা প্রমাণের জন্য নানান চেষ্টা করে যাচ্ছে।

    কিন্তু সমস্যা দেখা দিয়েছে। মুসলমান দিয়ে পূজা হয় না তার জন্য চাই হিন্দু। দেশে হিন্দু নাই তাতে কি জেলখানার হিন্দু পাওয়া যাবে কিন্তু শুধু হিন্দু তই পূজা হয়না তার জন্য চাই প্রতিমা আর প্রতিমা গড়ার মানুষ। এটারই অভাব। বিদেশ থেকে জরুরি ভিত্তিতে প্রতিমা আমদানি করা যায় কিন্তু ভারত ছাড়া আর কোনো দেশে প্রতিমা তৈরী হয়না। সিংহলের মাধ্যমে ভারত থেকে প্রতিমা আমদানীর পরিকল্পনাও বাতিল করতে হল – বেফাঁস হবার ভয়ে।

    সরকারী পটুয়া দিয়ে তৈরী হবে মা দূর্গার প্রতিমা। পূজা দেবেন বন্দী হিন্দুগণ। পূজক ইয়াহিয়ায় মালিকের ক্ষমা পেয়ে হবেন মুক্ত।





    এছাড়া, চৌধুরী শহীদ কাদের bdnews24.com - নামক অনলাইন পত্রিকায় লিখেছেন  পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর ডা. মালিক রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি দুর্গাপূজা আয়োজনের কথা কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর থেকে জানা যায়। বাংলাদেশে যে খুব স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে, হিন্দুরা ভারতে যাননি, ধর্মীয় সম্প্রীতির মধ্য দিয়ে সকলেই সুখে দিন কাটাচ্ছে এমন একটি সুখী সুন্দর পূর্ব পাকিস্তানের চিত্র আন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতে চাচ্ছিল পাকিস্তান। কিছুদিন পরেই ছিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন। পাকিস্তান বুঝতে পেরেছিল তাকে শক্ত কূটনৈতিক চাপে পড়তে হবে। দুর্গাপূজার আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে অন্য বার্তা দিতে এই আয়োজন। কিন্তু সমস্যা হল এই আয়োজনের জন্য হিন্দু পাবে কই? পাকিস্তানের সামরিক আগ্রাসনের মুখে দেশতো হিন্দু শূন্য। মুসলমানদের হিন্দু সাজিয়ে পূজা করাবে সেই রিস্কে গেলেন না গভর্নর সাহেব। কারাগার থেকে পূজা আয়োজনের জন্য কিছু হিন্দুকে মুক্তি দেওয়া হল। এবং তাদেরকে বাধ্য করা হল পূজা আয়োজনে। প্রতিমা তৈরি করতে গিয়ে মুখোমুখি আরেক সংকটের। অবশেষে ছবি দেখে সরকারের কারিগররাই তৈরি করল প্রতিমা। যুগান্তর লিখছে,  ‘… ডা. মালিকের নজরে পড়েছে দুর্গাপূজা। আর পায় কে? পরিকল্পনা তৈরি। সরকারি আনুকূল্যে হবে দুর্গপূজা। নৃত্যসহ আরতি। বিজয়া দশমীর কোলাকুলি।’

    তবে শেষমেশ দূর্গাপূজা হয়েছিলো কিনা কোনো উৎস থেকেই তা জানা সম্ভব হয়নি।  

    অন্যদিকে ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যসমূহের শরণার্থীদের জীবনে আসে অন্যরকম দুর্গাপূজা। আগের বছর যারা মহাধুমধামের সহিত পাড়ায় পাড়ায় পূজোর আয়োজন করেছিল এবার তাদের উদ্বাস্তু জীবন। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরার কয়েকটি শরণার্থী ক্যাম্পে স্থানীয়দের উদ্যেগে দুর্গাপূজার আয়োজন করা হয়। কলকাতার সল্টলেক শরণার্থী শিবিরের ২টি ক্যাম্পের বাসিন্দারা চার আনা, ছয় আনা চাঁদা দিয়ে গড়ে তোলেন একটি তহবিল। রেশনের টাকা বাঁচিয়ে প্রায় তিনশ টাকা সংগ্রহ করে আয়োজন করেন দেবী দুর্গার আরাধনা। শরণার্থী ছেলে মেয়েরা পুরানো কাপড় নিয়ে পূজায় সমবেত হয়। যুগান্তরে রবীন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ‘উৎসবের আনন্দ সব যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিয়েছে’ শিরোনামে লিখেছেন ‘কিশোর-কিশোরীদের নতুন জামা-প্যান্ট জোটেনি, পায়ে জুতো নেই, তবু তারা উৎসবের আনন্দে ঝলমল’। সল্টলেক পাঁচ নম্বর সেক্টরের শরণার্থী শিবিরের শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনায় খুবই সাদামাটাভাবে আয়োজন করা হয় দুর্গাপূজার। শেষ মুহূত্বে সিদ্বান্ত হয়েছে পূজার। ফলে হিমশিম খেতে হয় প্রতিমা জোগাড়ে। বেমি দামের কারণে কুমারটুলিতে গিয়ে হতাশ হয় উদ্যোক্তারা। অবশেষে কালীঘাট থেকে ৬০ টাকার বিনিময়ে জোগাড় করা হয় প্রতিমা।

    একাত্তরে শরণার্থী শিবিরগুলোতে পূজা এসেছিল অন্য এক আবহ নিয়ে, শপথ নিয়ে। একদিকে দেশহীন হওয়ার স্মৃতি, ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ আর উৎকন্ঠায় শারদ এসেছিল ক্ষণিকের স্বস্তি নিয়ে। আনন্দবাজারে প্রতিফলিত হয়েছে সেই সুর। ২৮ সেপ্টেম্বর আনন্দবাজার লিখছে, ‘… উৎসবের আনন্দে হাত বাড়িয়ে দিন, পূর্ববঙ্গের দুর্গতদের পাশে দাঁড়ান, আপনার পাশাপাশি তাদেরও উৎসবে যোগ দেওয়ার সুযোগ করে দিন।’


    ভারতের সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ পূজার সময় সব ধরনের সহায়তা নিয়ে শরণার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি শরণার্থী শিবিরের শিশুদের জন্য প্রায় লক্ষাধিক টাকার নতুন জামা-কাপড় ও শিশু খাদ্য কিনে দেন। নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, বসিরহাট, বনগাঁর শরণার্থী শিবিরগুলোতে অনেকেই ত্রাণ হিসেবে নতুন কাপড় দেন। ত্রিপুরা ও আসামে হিন্দু শরণার্থীদের পূজা উপলক্ষে নতুন কাপড় দেওয়া হয়। আসামের শিলচর, ত্রিপুরার আগরতলা, উদয়পুর, বিশালগড়, পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, বসিরহাট, বনগাঁ, সল্টলেকসহ অনেকগুলো ক্যাম্পে স্থানীয়রা দুর্গাপূজার আয়োজন করেন।      

    পূজা মণ্ডপে থিমের ব্যবহার তখন খুব নতুন বিষয়। এরপরও একাত্তরে দেবী দুর্গার মুখমণ্ডলে অনেকেই ইন্দিরাকে খুঁজে পেয়েছেন। দুর্গা সকলের যেমন আশ্রয়দাতা, ইন্দিরাও একাত্তরে শরণার্থীদের আশ্রয়দাতা ত্রাণকর্তা রূপে পাশে দাঁড়িয়েছিল। কলকাতার অনেক মণ্ডপে ছিল একজন জীবন্ত দেবতা- শেখ মুজিবের ছবি! বিস্মিত না-হয়ে সত্যি উপায় ছিল না। যে মুসলমানদের সংস্পর্শে এলে এককালে হিন্দুদের ধর্ম নষ্ট হতো, মুসলমানদের খাবার গন্ধ কোনোক্রমে নাকে ঢুকলে কুলীন ব্রাহ্মণও পীরালি ব্রাহ্মণে পরিণত হতেন, সেই মুসলমানদেরই একজনের ছবি দুর্গাপূজার মন্ডপে!

    মুজিবের ছবি ছাড়া কলকাতার লোকেরা পূজোর আনন্দটা ঠিক যেন পুরোপুরি অনুভব করতে পারছিলেন না।


    সুফির কার্টুনে ওঠে এসেছে পূজায় ভয়াবহ বৃষ্টির প্রকোপ
    বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রের পঞ্চদশ খণ্ডে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি এ আর মল্লিকের সাক্ষাৎকার থেকে বিষয়টির সত্যতা জানা যায়। সে বছর দুর্গাপূজার মণ্ডপে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানানো হয়েছিল। তার বর্ণনা মতে, ‘সে সময় ভারতে বাংলাদেশের সমর্থনে এমন একটি জোয়ার এসেছিল যে, সব জায়গায় এমনকি দুর্গাপূজা মণ্ডপের প্রবেশ দ্বারেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি টানানো দেখেছি’।

    মুহাম্মদ নূরুল কাদির তার লেখা ‘দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা’ বইয়ে লিখেছেন, ‘একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় কলকাতা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে বহু পূজামণ্ডপে বঙ্গবন্ধুর ছবি ফুল দিয়ে সাজিয়ে ঠাকুরের পাশে সম্মানের সাথে রাখা হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকেই বিশ্বাস করতেন যে, বিষ্ণু বা নারায়ণ নরদেহ ধারণ করে ‘অবতার’ হিসেবে পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছেন, সাত কোটি বাঙালিকে রক্ষা করার জন্য। সেই কারণেই একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে বহু হিন্দু বঙ্গবন্ধুকে  দেবদূত ও পূজ্য হিসেবে মান্য করতেন।’

    একাত্তরের সেই সময়ে অনেকেই ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে কিংবা প্রশিক্ষণ শিবিরে। সেই সময়ের বর্ণনা উঠে এসেছে অজয় দাশগুপ্তের স্মৃতিচারণে- ‘১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দুর্গা পূজায় ছিলাম ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পালাটানা নামের এক বনে। পাহাড়ি এলাকা, ছোট ছোট মাটির টিলা। গভীর ও অগভীর খাদও আছে। তবে এ সবের অবস্থান অপরূপ শোভা ছড়ানো বৃক্ষরাজির মাঝে মাঝে। এক রাতে খোলা ট্রাকে করে আমাদের প্রায় ১৭শ জনকে পৌঁছে দেওয়া হলো সেই বনভূমিতে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। পাহাড়ি কাঁচা মেঠো পথ। ট্রাকে ঝাঁকুনি প্রবল। পেটে ক্ষুধা। কিন্তু সব ভুলে যাই অনন্ত আনন্দের। পরদিন সকাল থেকে সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং শুরু হবে যে!’

    পূজার বর্ণনা দিতে গিয়ে অজয় দাশগুপ্ত লিখছেন, ‘আশপাশের শরণার্থী শিবিরগুলোতে দুর্গা পূজা হচ্ছে। প্রথম মন্দিরে গিয়েই আমরা অভিভূত। দেবী দুর্গার দশ হাতে দশ অস্ত্র, যে হাতে অসুরকে বিদ্ধ করা লেজা বা বল্লম। সে হাতেই ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি। আমাদের ব্যারাকের মাইকে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাজানো হয়। কিন্তু অনেক দিনের মধ্যে এই প্রথম বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখলাম। সেটাও আবার মন্দিরে, যেখানে পবিত্র আচার-অনুষ্ঠান মেনে পূজা হচ্ছে! চোখ দিয়ে জলের ধারা নেমে এলো। মন্দির দর্শনে বের হওয়া আমাদের দলের প্রায় সকলে মুসলিম ধর্মাবলম্বী। তারাও অভিভূত। জাতির পিতা মানুষের অন্তরে কী যে আসন করে নিয়েছেন, সেটা পাহাড়ি বনের মধ্যে এমন পূজার আয়োজনে না এলে বোঝাই যেত না।’

    সুখেন্দু সেন একাত্তরে মেঘালয়ের শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিল। একাত্তরের দুর্গাপূজার স্মৃতিচারণ করে লিখছেন, বালাটের শরণার্থীরা দুর্গাপূজাও করে। আয়োজনে আড়ম্বর নেই। ঢাকও বাজে না। প্রাণের অর্ঘ্য নিবেদনে কেবল প্রার্থনা- ‘মাগো, অসুরমুক্ত করে দাও জন্মভূমি। আমরা যেন ঘরে ফিরতে পারি।’

    একাত্তর ছিল বাঙালি হিন্দুদের জীবনে একটি অভিশাপ। হিন্দু মেয়েদের ক্রমাগত ধর্ষণ, নানাবিধ নির্যাতন, স্থানীয় রাজাকারদের উৎপাত অনেকটা নরক নেমে এসেছিল পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের জীবনে। রমনা কালি মন্দির, ঢাকেশ্বরী, শাখারী বাজারের মন্দির, চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম গুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানিরা। শরণার্থী হয়ে পালিয়েও স্বস্তি ছিল না। নানা ধরনের মহামারী, বন্যা শরণার্থী জীবনকে কঠিন করে তুলেছিল। দুর্বিষহ সেই সময়ে দেবী দুর্গার আগমন সনাতন ধর্ম বিশ্বাসীদের মনে কিছুটা হলেও প্রাণের সঞ্চার করেছিল। সকলে কায়মনে প্রার্থনা করেছিল বাংলাদেশ যেন অসুর মুক্ত হয়। 

    বাংলার কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের হাত ধরে ডিসেম্বরে বিজয় আসে। রাহুর গ্রাস থেকে মুক্তি পায় বাংলা ও বাঙালি। ফিরে আসে উৎসবের আনন্দ।