• সর্বশেষঃ

    মহাবীর হনুমান লেজ বিশিষ্ঠ কোন মর্কট প্রাণী ছিলেন না। (তৃতীয় পর্ব)


    এবার আপনার প্রশ্নে আসা যাক্। আপনি বলেছেন, রামায়ণে দু’এক স্থানে লেজের বর্ণনা দেখেছন। প্রথম কথা হচ্ছে আপনি, পুরাণ উপপুরাণ কৃত্তিবাসাদির বাংলা রামায়ণের কথা বাদ দিন। কল্পনাদেবীর অকৃপণ দয়ায়, যে কোন আজগুবি গাল-গল্প রচনায় (পুরাণ রচনাকার দের) তো এদের জুড়ী মেলা ভার! এরা তো হনুমান বা অঙ্গদের লেজকে কোথাও কোটি কোটি যোজন লম্বা করে দিয়েছেন, কোথাও বা লেজের কুণ্ডলি এমন পাকিয়ে দিয়েছেন যে তা আকাশ স্পর্শ করেছে!! হনুমান প্রভৃতি বানর এবং যক্ষ রক্ষরা যখন ইচ্ছা যে কোনরুপ ধারণ করতে পারে, এ বর্ণনাও এরা দিয়েছেন, হনুমান কখনও মক্ষিকার মত ক্ষুদ্রাকৃতি হচ্ছেন, আবার কখনও বা তার এত বিরাট কলেবর হয়ে গেল যে তার মাথাটা গিয়ে আকাশে ঠেকলো।(বা কখনো সূর্যকে গিলে খেল, এ সব কথা সুস্থ মস্কিতের কোন মানুষ কি বিশ্বাস করতে পারে?)

    হনুমানজীর যে লেজের কথা পাওয়া যায় সেটা শূন্যে যাতায়ত করার উপযোগী কোন বৈজ্ঞানিক যন্ত্র ছিল। হনুমান যখন সমুদ্র লঙ্ঘন করছেন, তখন মহর্ষি বর্ণনা দিচ্ছেন-

    উপপপাতাথ বেগেন বেগবান্ বিচারয়ন্
    সুপর্ণমিব চাত্মানং মেনে স কাপকুঞ্জরঃ।

    “বেগশালী হনুমান তখন মহাবেগে আকাশে উড়ে চললেন, নিজেকে তখন তিনি সুপর্ণ গরুড়ের ন্যায় ভাবলেন’।

    হনুমানের লাঙ্গুল(লেজ), শূন্যে গমনাগমনের জন্য ব্যোমযান বিশেষ হবে। হনুমানের লেজ যদি ব্যোমযানের মত যন্ত্র বিশেষ না হবে, তাহলে তাতে উড়া যায় কি করে? বর্ত্তমানেও তো বানরের বা অন্যান্য জীবজন্তুর লেজ দেখতে পাই, তার দ্বারা তারা তো কৈ উড়তে পারে না? তাই আমার মনে হয়, মহাবীর হনুমানের ত্যাগ, তপস্যা, পরাক্রম মহাপাণ্ডিত্য আদি চিন্তা করে, সবদিকের সঙ্গতি রেখে তাকে লেজ বিশিষ্ট একটি জন্তু না ভেবে, তার লেজটি যে একটি বায়ুচালিত যন্ত্র বিশেষ, এই ধারণ করাই অধিকতর যুক্তিসঙ্গত। আমার এ ধারণা আরও দৃঢ়তর হয় মূল রামায়ণের পরবর্ত্তী বর্ণনায়-

    তস্য বানর সিংহস্য প্লবমানস্য সাগরম্
    পক্ষান্তরগতো বায়ু জীমুত ইব গর্জ্জতি।

    “সাগর লঙ্ঘনকারী প্লবমান হনুমানের পক্ষান্তরগত বায়ু মেঘের মত গর্জ্জন করছে”।

    বর্ত্তমানে আকাশে এরোপ্লন উড়লে যে শব্দ হয়, ঐ বায়ুগর্জ্জন সেই ধরণের কোন কিছু স্মরণ করায় না কি? আরও ভেবে দেখ, তার ঐ লাঙ্গুল কৃত্রিমভাবে দেহের সঙ্গে সংযুক্ত ছিলো বলেই রাক্ষসরা লেজে আগুন দিলেও হনুমানের গায়ে তাপ লাগে নি। ধরো তোমার আঙ্গুলে যদি ফাউন্টেনের খাপটা ঢুকিয়ে দিয়ে তাতে দিয়েশালাইএর কাঠি জ্বালি, চট্ করে কি তোমার আঙ্গুল পুড়ে যাবে? তুমি প্রজলিত খাপটা আঙ্গুলে তাপ লাগবার পূর্ব্বেই জলে ডুবিয়ে নিভিয়ে ফেলতে পার, তেমনি হনুমানের লেজ কৃত্রিম ছিল বলে, কৃত্রিমভাবে দেহের সঙ্গে সংযুক্ত কোন যন্ত্র বিশেষ বলেই, তিনি লঙ্কাদাহের পর সমুদ্রের জলে ডুবিয়ে তা নিভিয়ে দিতে পেরেছিলেন ঐ জন্যই তিনি অক্ষত ছিলেন।

    তোমার প্রশ্নের দ্বিতীয় অংশে বলেছ, “বনের পশুকেও রামচন্দ্র কোল দিয়েছিলেন’ এ কথা তাহলে চলে আসছে কেন? কিংবদন্তী হিসেবে অনেক কিছুই চলে আসতে পারে, রামচন্দ্র মৈত্রী ও করূণার প্রতিমূর্ত্তি ছিলেন- তিনি আব্রহ্মচণ্ডাল কাউকে ঘৃণা করতেন না, এ জন্যও ও কথাটা প্রচলিত হতে পারে, তাই বলে বালী সুগ্রীব হনুমানকে পশু হতে হবে, এ কোন যুক্তিযুক্ত কথা নয়। চিন্তা করে দেখ না, ক্ষত্রকুলতিলক মহাযোদ্ধা শ্রীরামচন্দ্র কি কয়েকটা “পশুজাতি” বানরের সাহায্য চেয়ে ছিলেন দেবদৈত্যরণজয়ী মহা পরাক্রমশালী শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ্ রাবণের সঙ্গে সংগ্রামের জন্য? সমান্য শাখামৃগের সঙ্গে মিতালী করেছিলেন? মন্ত্রণা গ্রহণ করতেন একটা ভল্লুকের? ধীরবুদ্ধি, প্রাজ্ঞ জাম্বুবান কি, বর্ত্তমানে যে ভল্লুক দেখা যায় সেই জানোয়ারের সমগোত্র হবেন বলে মনে হয়?

    ইন্দ্রের পুত্র বালী, সূর্য্যের পুত্র সুগ্রীব, পবনপুত্র হনুমান, বালী সুগ্রীব হনুমান যদি বন্য বানর শ্রেণীর জন্তু হন, তাহলে কি তোমাদের দেবতারা বানরীর সঙ্গে মিলন করেছিলেন বলতে চাও?

    অহো, অবিদ্যার মহিমা কী অপার! বিশ্বকর্ম্মাপুত্র নল সমুদ্রের উপর সেতু নির্ম্মাণে যে উন্নত ইঞ্জিনীয়ারিং বিদ্যার পরিচয় দিয়েছিলেন তা কি কোন বন্য বানর হলে সম্ভব? জ্ঞানবিজ্ঞানে সমুন্নত এমন যারা তাদেরকে মানুষেরই সমগোত্রীয়, সমশ্রেণীর জীব না ভেবে বন্য বানর, পশু, বল কোন যুক্তিতে?

    দেখ ভাই সুগ্রীব হনুমানাদি বানররা বন্য বানর ছিলেন না; গুণ ব্যবহার, আচার, ধর্ম্মাচরণ প্রভৃতি ব্যাপারে প্রভেদ অনুযায়ী, যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব্ব, সুর, অসুর, নর, বানর এই রকম নাম মাত্র- একই মানুষ জাতি- এই ভাবেই মহর্ষি বাল্মীকি কিস্কিন্ধ্যায় তৎকালে যারা বাস করতেন, তাদেরকে “বানর” নামে অভিহিত করেছেন। কিন্তু কল্পনা প্রিয় পুরাণ, উপপুরাণ, বাংলা রামায়ণ রচয়িতারা “বানর” বলতে লাঙ্গুলবিশিষ্ট বন্য বানর বলে বিভ্রান্ত করেছে। বন্য বানররাও সে সময় ছিল। লঙ্কাকাণ্ডে আছে, ওষধি সংগ্রহের জন্য হনুমান যখন সমুদ্র-লঙ্ঘন উদ্দেশ্যে, ত্রিকূট পাহাড় থেকে লাফ দিলেন, তখন ত্রিকূটের বৃক্ষ সকল ভগ্ন, শিলাগুলি বিকীর্ণ এবং পর্বত বিঘুর্ণিত হতে থাকলে বানরগণ তার উপর থাকতে পারলো না-

    তস্মিন্ সম্পাড্যমানে তু ভগ্নদ্রুম শিলাতলে
    ন শেকুর্বানরাঃ স্থাতুং ঘুর্ণমানে নগোত্তমে। ৩৯
    স বৃক্ষখণ্ডাংন্তরসা জহাব
    শৈলান্ শিলা প্রাকৃত বানরাশ্চ। [লঙ্কাকাণ্ড, ৪৬, ৭৪]

    একটা এরোপ্লেন আকাশে উড়লে, তার মহাশব্দে যেমন বানররা হুপ, হাঁপ শব্দে গাছে গাছে লাফিয়ে পড়তে দেখি, তেমনি হনুমানজীর বেগ প্রভাবে বৃক্ষচূড়া ধ্বসে পড়লো, বন্য বানররা ভয়ে সমুদ্রজলে লাফিয়ে পড়লো। এই বন্যবানরদের সমপর্য্যায়ে কিস্কিন্ধ্যাবাসী দেবসন্তান বালী সুগ্রীব হনুমানাদিকে পশুশ্রেণীর ভেবে বসা কি যুক্তিযুক্ত?

    শক, হুন, বেদুইন, মঙ্গোলিয়ান, দ্রাবিড়, গ্রীক যেমন এক একটা জাতি, রীতি, নীতি, আচার, ব্যবহারে তফাৎ থাকলেও দেশ অনুযায়ী নামের পার্থক্য থাকলেও এরা সবাই যেমন মানুষগোত্র, আকৃতি গঠনে মানুষ তেমনি, কিস্কিন্ধ্যায় রাজত্ব করতো যে বানর জাতি, বালী, সুগ্রাব, হনুমান, নল, নীল সুষেণ যে জাতির গৌরব, তারাও সবাই মনুষ্যদেহধারী ছিলেন, মানুষ ছিলেন।

    বাল্মীকি রামায়ণে এদের বিদ্যা, জ্ঞান, উন্নত শিল্পকলা, সঙ্গীত চর্চ্চা, বহুমূল্য বেশভুষা, অলঙ্কার প্রসাধন পারিপাট্যের যে পরিচয় পাই, তাতে এদেরকে কি ভাবে এতকাল ধরে, আমাদের দেশের জ্ঞানীগুণী পরমহংসের দল থেকে সাধারণ লোক পর্য্যন্ত বন্য বানর, পশু-জন্তু ভেবে এসেছেন- এইটেই আশ্চর্য্যের বিষয়!