• সর্বশেষঃ

    মহাবীর হনুমান লেজ বিশিষ্ঠ কোন মর্কট প্রাণী ছিলেন না। (দ্বিতীয় পর্ব)



    প্রশ্ন- আপনে ভারী তো মজার কথা বললেন, রামায়ণে তো আমরা হনুমানের লেজ আছে দেখি, তারা মানুষের মত জীব হবে কি করে? তাহলে নল, নীল, সুষেন এমন কি ভল্লুক রাজ জাম্বুবানও কি তাহলে মানুষ? যদি ওরা পশুই না হবে, তাহলে রামচন্দ্র বনের পশুকে কোল দিয়েছিলেন, এ কথা চলে আসছে কেন? হনুমানের যদি লেজই না ছিল তাহলে লঙ্কাদাহ করলো কি দিয়ে?

    উত্তরঃ দেখুন! মূল পুস্তকে এক রকম থাকে আর পুরাণ উপপুরাণে তার অতিরঞ্জন এবং অনুরঞ্জন ঘটে। মহর্ষি বাল্মীকির রামায়নে দু’এক স্থানে লেজের কথা আছে বটে কিন্তু পুরাণকারেরা এবং অজ্ঞ জন সাধারণ পূর্বাপর বিচার না করেই, হনুমান বলতেই লেজ বিশিষ্ট; বর্তমানে যে মর্কট বানরদল গাছে গাছে দেখা যায়, তাদেরই সমগোত্র ভেবে বসলো। এই ভাবে একই প্রজাপতি গোত্র হলেও যক্ষ, রক্ষ, গন্ধর্ব, কিন্নর গরুড়াদি সুপর্ণ নাগ সবাইকে মনুষ্যেতর কিম্ভুত কিমাকার জীবে ভেবে বসে আছে। একটা বদ্ধমূল ধারণা চলে আসছে এমন ভাবে যেন, নাগ বললেই বিষধর সাপ, উদ্যত করালফণা নিয়ে দংশন করতে আসছে, কিন্নর বলতেই যেন ঘোড়ার মত মুখ কামচর্চ্চকারী এক প্রকার জীব আর রাক্ষস বলতেই বিকট দর্শন রক্তপিপাসু, নরখাদক দস্যু নারীহরণ করা আর গোটা গোটা মানুষ জীব জন্তু গিলে ফেলাই তাদের স্বভাব।

    অথচ ঐ সব যক্ষরক্ষ সুপর্ণদের যে শৌর্য্য বীর্য্য পাণ্ডিত্য ও তপোবলের পরিচয় পাওয়া যায়, তারা যে একই পিতা কশ্যপ থেকেই জন্মেছে, তারা মনুষ্যেতর পশুপাখী সাপ কি করে হবে, সে সব ভেবে দেখবে না? মনুষ্য মাতাপিতার শুক্রশোণিত সংযোগে সাপ ভালুক পাখী বানরাদির কি করে জন্ম সম্ভব তাও একবার বিবেচনা করে দেখবে না? এ অজ্ঞতা যে কবে দেশ থেকে দূর হবে, তা জগদীশ্বরই জানেন, স্বাধীন চিন্তাধারার প্রসারতা না ঘটলে এ অজ্ঞতা কোনদিনই যাবে না।
    হনুমানাদি বানর, গরুড়াদি পাক্ষী, তক্ষকাদি নাগ, রাবনাদি রাক্ষস এরা সবাই মানুষের প্রতিবেশী মানুষই ছিলেন, কেবলমাত্র গুণগত, আচার ব্যবহারগত পার্থক্য ছিল।

    রামায়ণে আমরা দেখি, বানরগণ যখনই একে অপরের কাছে শ্রীরামচন্দ্রের পরিচয় দিয়েছেন, তখনই তারা এইভাবে পরিচয় দিয়েছেন “ইক্ষাকুনাং কুলে জাতঃ” বলে, কিন্তু “মনুষ্যানাং কুলে জাতঃ” একথা তো কোথাও বলেন নি? আমরা যেমন কারও পরিচয় দিতে গিয়ে বলি, ইনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বংশধর, কিংবা লোকমান্য তিলকের বংশধর, কখনও কি বলি, ইনি মানুষের বংশে জন্মেছেন? মানুষ মানুষের পরিচয় দিতে গিয়ে কখনও এরকম ভাবে বলে না। বানরজাতি যদি মানুষ হতে পৃথক একটা জাতি হত, তাহলে (শ্রীরামচন্দ্রের পরিচয় দেওয়ার সময়) “ইক্ষাকুর বংশে ইনি জন্মেছেন” না বলে, ইনি “মানুষের বংশে জন্মেছেন’- এই কথাই বলতেন।

    অশোক কাননে হনুমান সীতাকে প্রশ্ন করছেন-
    সুরানাম্ অসুরানঞ্চ, নাগগন্ধর্ব্ব রাক্ষসাম্
    যক্ষাণাং কিন্নরাণাঞ্চ কা ত্বং ভবসি শোভনে!
    [বাল্মীকি রামায়ণ, সুন্দরকাণ্ড ৩৩ অধ্যায়, ৫ শ্লোক]

    সুর, অসুর, নাগ, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, রক্ষ, কিন্নর কোন কুলে আপনি জন্মেছেন?

    তাহলেই বেশ বোঝা যাচ্ছে, সুর, অসুর, নাগ, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, রক্ষ কিন্নর এবং মানুষের মধ্যে শারীরিক গঠনের বৈষম্য ছিল না। যদি থাকত তাহলে সেই বিশেষ বৈশিষ্ট্য থেকেই অর্থাৎ রাক্ষসের লম্বা লম্বা রক্তাক্ত দাঁত, কিন্নরের অশ্বমুখ প্রভৃতি বৈশিষ্ট্য দেখেই তিনি সহজেই বুঝতে পারতেন, মাতা সীতা কোন বংশের ছিলেন। লক্ষ্য করুন, এ শ্লোকে “মানুষ” কথাটি নেই। কারণ, হনুমান নিজেও মানুষ ছিলেন, তিনি অপর মানুষ দেহধারী আর একজনকে তিনি মানুষ কিনা এ অবান্তর প্রশ্ন করবেন কেন?

    দেব, যক্ষ, রক্ষ কিন্নর আর মানুষ আকৃতিতে কোন অমিল ছিল না, পারস্পরিক বৈষম্য ছিল শুধু শৌর্য্যে বীর্য্যে শিল্পকলায় আচার বিচার আর ধর্ম্ম-বিশ্বাসে, তাই হনুমান সীতাকে ঐ ভাবে প্রশ্ন করছেন, যেমন আমরা কাউকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি চীনা, না জাপানী? না, হাঙ্গেরিয়ান? ইংরেজ, না ফারাসী? বৌদ্ধ, না, খ্রীষ্টান? ইত্যাদি। মানুষ যে তারই প্রতিবেশী, সমগোত্র, বানর, সুপর্ণ যক্ষ রক্ষকে হীন কদাকার কিম্ভুত কিমাকার জীব রূপে যে রটনা করেছে, এ বড় লজ্জার কথা।