• সর্বশেষঃ

    মহাবীর হনুমান কি লেজ বিশিষ্ঠ কোন মর্কট প্রাণী ছিলেন? (প্রথম পর্ব)


    (আর্টিকেলটির সূত্রঃ আলোক-তীর্থ, শ্রী শৈলেন্দ্রনারায়ণ ঘোষাল শাস্ত্রী)

    এমন কোন চিত্রপট বা মূর্তি পাওয়া যাবে না যেখানে মহাবীর হনুমানজীর লেজ নাই। সারা ভারতবর্ষে, আজ এই দুর্দ্দশা! সাধু, পরমহংস, মণ্ডলেশ্বর, মহামণ্ডলেশ্বরদের প্রতিষ্ঠিত হনুমান মন্দিরে সলাঙ্গুল (লেজ বিশিষ্ট) হনুমানজী পূজা পাচ্ছেন!! ঐ সব মহপুরুষদের দশ, বিশ হাজার বা লক্ষ লক্ষ শিষ্যও আছে। তারা সর্ব্বজ্ঞ, অবতার, ভগবান আরো কত কি? বলে শিষ্য সমাজে প্রচারিত এবং সম্মানিত, পূজিত। (তাদের চরণ ধৌত জল মস্তকে ধারণ করার জন্য ভক্তকুল হুমড়ি খেয়ে পড়ে) কিন্তু ঐ সব “সর্ব্বজ্ঞদের’ মহাবীর হনুমান সম্বন্ধে অজ্ঞতা দেখে হাস্য সংবরণ করা অত্যন্ত কঠিন।

    যেমন শ্রীরামকৃষ্ণও একসময় মহবীর হনুমানজীর ধ্যান করতেন, তিনি বলেছেন...... “ঐ সময়ে আহার বিহারাদি সকল কার্য্য হনুমানের ন্যায় করিতে হইত– ইচ্ছা করিয়াই যে করিতাম তাহা নহে, আপনা আপনিই হইয়া পড়িত। পরিবার কাপড়খানোকে লেজের মত করিয়া কোমরে জড়াইয়া বাঁধিতাম, উল্লঙ্ঘনে (লাফ দিয়ে) চলিতাম, ফলমূলাদি ভিন্ন অপর কিছুই খাইতাম না- তাহাও আবার খোসা ফেলিয়া খাইতে প্রবৃত্তি হইত না, বৃক্ষের উপরেই অনেক সময় অতিবাহিত করিতাম এবং নিরন্তর “রঘুবীর, রঘুবীর’ বলিয়া গম্ভীর স্বরে চীৎকার করিতাম। চক্ষুদ্বয় তখন সর্ব্বদা চঞ্চল ভাব ধারণ করিয়া ছিল এবং আশ্চর্য্যের বিষয় মেরুদণ্ডের শেষ ভাগটা ঐ সময়ে প্রায় এক ইঞ্চি বাড়িয়া গিয়াছিল।"
    [শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ লীলাপ্রসঙ্গ, ২য় খণ্ড, ১৩৯ পৃষ্ঠা] (এই মানসিক বিকারগ্রস্থ মানুষটা নাকি হিন্দুদের ভগবান)

    যায়হোক! ত্যাগ, তপস্যা অচ্যুত ব্রহ্মচর্য্য, অমিত শক্তি আর প্রজ্ঞার যিনি আধার ছিলেন, সেই হনুমানজীকে লেজ বিশিষ্ট না করলে, তোমাদের সাধু পরমহংস পুরাণকার আর ধর্ম্মাচার্য্যদের সর্ব্বজ্ঞাতা এবং ত্রিকালদর্শিতা প্রমাণিত হবে কি করে? আজকাল যাত্রা, থিয়েটার, হিন্দী সিনেমাদিতে যখন রাম বিষয়ে কোন ছায়াচিত্রে হনুমান বেশী নটের পেছনে বিরাট লেজ-যোজনা দেখি, তখন লজ্জায় মাথা নত হয়। আমাদের দেশের মহা মহা বিদ্বানদের তরফ থেকেও এর কোন প্রতিবাদ হয় না। বিদ্বানদের কথা না হয় বাদ দিলাম, তারা তাদের পুঁথিগত বিদ্যা জনশ্রুতি আর পুরাণ বর্ণিত বিষয়ের কুজ্ঝটিকার (কুয়াশার) আবরণ ভেদ করতে অক্ষম হতে পারে, কিন্তু যারা নাকি সর্ব্বান্তর্য্যামী, যুগাবতার, যুগদেবতা, দ্রষ্টাপুরুষ বলে কথিত, তাদের সর্বজ্ঞ বুদ্ধিটি সত্য-মিথ্যা নির্ণয়ে অক্ষম হয় কেন?

    মহাবীর হনুমানজী সাধারণের প্রচলিত ধারণানুযায়ী, দীর্ঘ পুচ্ছসমন্বিত লোমশ বৃক্ষারূঢ় মর্কট প্রাণী ছিলেন না। হনুমানজী মানুষ ছিলেন, যেমন- রামকৃষ্ণের কু-ধারণানুযায়ী তার লেজ ছিল না।

    আমার দোষ এই যে, তোমাদের মত সরল বিশ্বাসে সাধু পরমহংসদের কথা বা পুরাণের কথা মেনে নিতে পারি না, অভ্রান্ত সত্যরূপে; দাতা দয়াল যেটুকু বুদ্ধি বিবেক দিয়েছেন, তাই দিয়ে বিচার করে দেখে, মহাবীর হনুমান সম্বন্ধে আমার ধারণা হয়েছে যে, তিনি শৌর্য্যে বীর্য্যে ত্যাগ তপস্যায় মহত্বে একজন মানবশ্রেষ্ঠ ছিলেন- তার মানুষের মতই ব্যক্তিত্ব ছিল।

    মূলবাল্মীকি রামায়ণ সহ রামায়ণের সর্ব্ব প্রাচীন টীকা রামায়ণ কতক, রামবর্ম্মণের তিলক টীকা, গোবিন্দরাজের শৃঙ্গার তিলক টীকা, মহেশ্বর তীর্থ, বরদরাজ, মৈথিল ও নাগেশ ভট্টের রামায়ণের টীকা, ত্রম্বকযজ্বনের ধর্ম্মকূট, রামানন্দ তীর্থের রামায়ণকুট ইত্যাদি টীকাগুলি তন্ন তন্ন করে, জ্ঞানবুদ্ধিমত অনুসন্ধান করে, রামায়ণ-বর্ণিত (শুধু হনুমান নয়, এমনকি) বালী, সুগ্রীব সহ হনুমানও যে মানুষ ছিলেন, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। তোমরাও যদি সংস্কার মুক্ত মন নিয়ে সব বিচার করে দেখ, তাহলে আশা করি, আমার সঙ্গে এক মত হবে।

    বাল্মীকি রামায়ণে পাই, সীতা হরণের পর সীতান্বেষণে রাম লক্ষণ, সুগ্রীব হনুমানাদি যেখানে ছিলেন সেখানে পৌঁছলেন, তখন সুগ্রীবের নির্দ্দেশে হনুমান এগিয়ে গিয়ে তাদের সঙ্গে যে বুদ্ধিমত্ত সৌজন্য ও শিষ্টাচার সহ আলাপ করলেন, তাতে তিনি যে একজন শাখামৃগ মর্কটাকৃতি ছিলেন, এ ধারণা একমাত্র তোমাদের মত সাধু পরমহংস পুরাণকারের দল ছাড়া আর কেউ বিশ্বাস করতে পারবেন না।

    হনুমানের বাক্যালাপে, অতুলনীয় বাচনবঙ্গীতে মুগ্ধ হয়ে রামচন্দ্র লক্ষণকে তার সঙ্গে স্নেহপূর্ণ মধুর বাক্যে আলাপ করতে নির্দ্দেশ দিয়েছিলেন-
    [বাল্মীকি রামায়ণ, কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ড, তৃতীয় সর্গ, ২৭]

    হনুমানের বচন পারিপাট্যে মুগ্ধ হয়ে রামচন্দ্র লক্ষণকে বলেছিলেন, “নিশ্চয় ইনি মহাপণ্ডিত; ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্ব্বেদে পারদর্শী না হলে কেউ এরকম জ্ঞানগর্ভ বাক্যালাপ করতে পারে না। ইনি নিশ্চয়ই সমগ্র ব্যাকরণ শাস্ত্রও অধিগত করেছেন আমার সঙ্গে এত কথা বললেন, তবুও একটিও অপশব্দ প্রয়োগ করেন নি- [ঐ, কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ড, তৃতীয়সর্গ]

    সীতান্বেষণে সুগ্রীব যখন চারিদিকে তার সৈন্যবাহিনীকে পাঠালেন, তখন শ্রীরাম বিশেষকরে এই মহাবীর হনুমানকেই সম্বোধন করে বললেন-
    “বীর হনুমান, যাতে সীতার অনুসন্ধান পাওয়া যায়, তা অবশ্যই করো। তুমি রাজনীতিবিদ্, বল বিক্রম বুদ্ধি শৌর্য্য সবই তোমাতে আছে। দেশ কাল পাত্রনুযায়ী কখন কি করতে হবে, এ সব নীতিতত্ত্বে তুমি বিশারদ”। [কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ড, তৃতীয়সর্গ]
    (এই রকম বেদজ্ঞ, মহাবিক্রমী একজন ব্যক্তিত্বকে লেজ বিশিষ্ট মর্কট প্রাণী বলে মনে করার মত, বুদ্ধিভ্রষ্ট আপনাদের হল কি করে?)

    কাজেই, ভারতবর্ষের ঘরে ঘরে, তোমারা মহাবীর হনুমানের লেজ বিশিষ্ট বিকৃত মুখ প্রতিমূর্ত্তি গড়ে পূজা করলেও এবং ঐ বিকৃত রূপের ধ্যান করতে করতে, (রামকৃষ্ণের মত) তোমাদের সকলের লেজ গজিয়ে উঠলেও.... বেদজ্ঞ, সর্বশাস্ত্রার্থবিদ, মহাবিক্রমী, পরম তপস্বী হনুমানজীকে তোমাদের মত শাখামৃগো বানর পর্যায়ে ফেলা আমার পক্ষে অসম্ভব।