• সর্বশেষঃ

    গীতা সমীক্ষাঃ পর্বঃ৪ গীতায় বর্ণীত ঈশ্বর কি সাকার না নিরাকার?


    ময়া ততমিদং সর্বং জগদব্যক্তমূর্তিনা। 
    মৎস্থানি সর্বভূতানি ন চাহং তেধবস্থিতঃ ৷৷ গীতা৯/৪ ॥ 
    ন চ মৎস্থানি ভূতানি পশ্য মে যােগমৈশ্বরম্।
    ভূতভূন্ন চ ভূতছাে মমাত্মা ভূতভাবনঃ ৷৷ গীতা৯/৫||

    পদার্থঃ [ইদ (এই) ; সর্বম্ (সমগ্র) ; জগৎ (জগতে) ; ময়া (আমি) ; অব্যক্তমূর্তিনা (অব্যক্ত স্বরূপে) ; ততম্ (পরিব্যাপ্ত) ; সর্বভূতানি (সমস্ত প্রাণী); মৎস্থানি (আমাতে অবস্থিত); চ (কিন্তু) ; অহম্ (আমি); তেষু (সেসবে); ন, অবস্থিত (অবস্থিত নই) ; চ (এবং); ভূতানি (প্রাণীরাও) ; মৎস্থানি (আমাতে অবস্থিত) ; ন (নয়); মে (আমার); ঐশ্বরম্‌ যােগম্‌ (ঐশ্বরিক যােগ) ; পশ্য (দর্শন কর); ভূতভাবনঃ (সকল প্রাণীর উৎপাদক); চ (এবং) ; ভূতভৃৎ (তাদের ধারক ও পােষক) ; মম (আমার) ; আত্মা (স্বল্প); ভূতঃ (ওই স্কল প্রাণীতে); ন (নয়।)]।

    অনুবাদঃ সমস্ত জগতে আমি অব্যক্তস্বরূপে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছি। সমস্ত প্রাণী আমাতে অবস্থিত। কিন্তু আমি সে সবে অবস্থিত নই এবং ওই প্রাণীরাও আমাতে অবস্থান করে না—আমার এই ঐশ্বরিক যােগ (সামর্থ্য) দর্শন কর। সকল প্রাণীর উৎপাদক এবং তাদের ধারক ও পােষক হলেও আমার স্বরূপ ওইসব প্রাণীতে অবস্থিত নয় ॥ গীতা৯/৪-৫ ।

    এখান থেকে আমরা ৩ টা বিষয় বুঝতে পারিঃ

    ১। গীতায় আমি বলতে যাকে বোঝানো হয়েছে তিনি ঈশ্বর যিনি অব্যক্তস্বরূপে পরিব্যাপ্ত।

    সিদ্ধান্তঃ নিরাকার আত্মা যেমন মানব দেহের কনো নির্দিষ্ট স্থানে বাস করেনা তথাপি আত্মা সারা শরীরে অবস্থিত তেমনি নিরাকার পরমাত্মাও কনো নির্দিষ্ট জীব বা জড়তে অবস্থান করে না বরং সমস্ত মহাবিশ্বের আত্মা রূপে অবস্থান করেন।
     এ বিষয়ে ঈশোপনিষদে বলা হয়েছে- ঈশা বাস্যমিদ্ঁসর্বং যৎকিঞ্চ জগত্যাং জগৎ। (ঈশো ১) - "এই জততে যা কিছু জড়-চেতন পদার্থ সমুদয় আছে, তা সবই ঈশ্বর দ্বারা ব্যাপ্ত"। 

    ২। সমস্ত প্রাণী তার ভেতরেই অবস্থিত কিন্তু তিনি সে সবে অবস্থিত নন।

    সিদ্ধান্তঃ ঈশ্বর কোনো বস্তু বা প্রাণীর ভেতর অবস্থান করেন না। বরং তারা ঈশ্বরের ভেতরেই অবস্থিত। তাই কনো প্রাণী বা বস্তু রুপে ঈশ্বরের উপাসনা করা বোকামি।

    ৩। ঈশ্বরের স্বরূপ ওইসব প্রাণীতে অবস্থিত নয় ।

    সিদ্ধান্তঃ তাহলে মানবরূপী শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয়। তিনি কেবল যোগের মাধ্যমে পরমাত্মার সাথে যুক্ত হয়ে ঈশ্বরের কথা গুলোই অর্জুনকে বলছেন। তার মানে "আমি" বলতে এখেনে পরমাত্মাকে বোঝানো হয়েছে।

    আবার, 
    যথাকাশস্থিতো নিত্যং বায়ুঃ সর্বত্রগো মহান্। 
    তথা সর্বাণি ভূতানি মৎস্থানীত্যুপধারয়।।(গীতা ৯/৬)  

    পদার্থঃ সর্বত্রগঃ (সর্বত্র বিচরণশীল); মহান্ (মহা); বায়ুঃ (বায়ু); যথা(যেমন); নিত্যম্ (নিত্য); আকাশ-স্থিতঃ (আকাশেই অবস্থিত); তথা(তেমনই); সর্বাণি(সমস্ত); ভূতানি(প্রাণী); মৎস্থানী(আমাতে অবস্থিত); ইতি(এইরূপ) উপধারায়(জানবে)  

    অনুবাদঃ সর্বত্র বিচরণশীল মহাবায়ু যেমন নিত্য আকাশে বিচরণশীল, তেমনই আমাতে সমস্ত প্রাণী অবস্থিত - এইরূপ জানবে। নোটঃ (আকাশ বলতে পৃথিবীর উপরস্থিত ফাঁকা স্থান কে বোঝানো হয়েছে বায়ুশূণ্য মহাকাশ নয় কিন্তু)  

    সিদ্ধান্তঃ বায়ু যেমন নিত্য আকাশে  অবস্থান করে, কোথাও নিঃস্পন্দন ভাবে, কোথাও সামান্য ক্রিয়াশীল ভাবে, কোথাও বা বেগের সঙ্গে প্রবাহিত হয়। কিন্তু যে রূপেই থাক তাকে আকাশ(ফাঁকা স্থান) থেকে আলাদা করা যায় না তেমনি মহাবিশ্বের কোনো জীব বা জড়কে ঈশ্বর থেকে পৃথক করা সম্ভব নয়। এ জন্যই বলা হয়, ঈশ্বর সব কিছুতেই আছেন। তার মানে এই নয় যে কোনো জীব বা জড়কে ঈশ্বরের স্বরূপে কল্পনা করা যাবে।

    গীতায় বর্ণীত ঈশ্বর কি সাকার না নিরাকার? স্বয়ং বিচার করুন।