• সর্বশেষঃ

    “রঙ্গিলা রাসুল” নামক পুস্তক এবং উপমহাদেশে মুক্তচিন্তার উপর ইসলামী জিহাদের সূচনা।


    ১৯২০-এর দশকে পাঞ্জাবের মুসলিম এবং আর্য সমাজের মধ্যে একটি ধর্মীয় সংঘাত সৃষ্টি হয়েছিল। এই সংঘাতের সূত্রপাত হয়েছিল যখন মুসলিমরা একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল, যেখানে মাতা সীতাকে পতিতা হিসেবে দেখানাে হয়। এর জবাবে আর্য সমাজের স্বামী দয়ান্দের এক অনুসারী কৃষ্ণ প্রসাদ প্রতাব( নিশ্চিত হওয়া যায়নি), পণ্ডিত চামুপতি লাল ছদ্মনামে  “রঙ্গিলা রাসুল” নামে একটি পুস্তিকা লেখেন, যেখানে মহম্মদের শিশু আয়েশাকে বিয়ে এবং মহম্মদের বহুবিবাহের বিষয়কে আলোকপাত করা হয়। এই বইয়ের প্রকাশক ছিলেন লাহােরের  রাজপাল। তিনি ১৯২৩ সালে পুস্তিকাটি প্রকাশ করেন।  

    বইটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথে মুসলিমদের তথাকথিত ধর্মানুভুতি আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং আদালতে মামলা করে।ভারত বর্ষের নানা স্থানে প্রচন্ড বিক্ষোভ করেন মুসলমানরা। বই নিষিদ্ধ, লেখক-প্রকাশকের শাস্তি দাবী করতে থাকে। মহাত্মা গান্ধী নিজেও এই বই প্রকাশের সমালোচনা করেন। তবে চাপের মুখে পড়েও প্রকাশক বইটির আসল লেখকের নাম প্রকাশ করেননি।

    আদালত প্রথমে রাজপালকে দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করে। পরবর্তীতে আপিল করা হলে কোর্ট এই বিচারকে সমর্থন করে। সুবিচার লাভের প্রত্যাশায়, রাজপাল হাইকোর্টে  এবং হাইকোর্ট তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে, কারণ তিনি যা করেছেন, তা ইন্ডিয়ান পেনাল কোড-এর ১৫৩ ধারা অনুযায়ী কোনাে অপরাধের মধ্যে পড়ে না। বই নিষিদ্ধের ব্যাপারে মামলা হলে কোর্ট বলে দেয়, এই বইতে যা আছে তা সহিহ হাদিস গ্রন্থ থেকেই নেয়া, মিথ্যা তথ্য নেই। অর্থাৎ নিষিদ্ধের দাবী ব্যর্থ হয়। হাইকোর্টের এই সিদ্ধান্ত মুসলিমদেরকে গভীরভাবে ক্ষুব্ধ করে।

    'রঙিলা রসুল' এর প্রতিবাদে মুসলামনরা পাল্টা হিন্দুদের শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর সহস্র গোপিনীকে নিয়ে দুইটা বইও প্রকাশ করেন।

    ইলমুদ্দিন নামে লাহোরের এক তরুণ মসজিদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ সময় মসজিদের কাছে অনেক লোকের ভীড় করে রাজপালের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল।
    এ সময় ইলমুদ্দিন সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি রাজপালকে তার দোকানে গিয়ে ছুরিকাঘাতে হত্যা করবেন। অর্থাৎ ইতিহাসের অন্য জঙ্গিদের মত সেও “রঙ্গিলা রাসুল” নামক পুস্তক না পড়েই সে খুনের সিদ্ধান্ত নেয়।

    তারপর ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯২৯ সাল। সে হত্যার উদ্দেশ্যে বাজার থেকে ছুরি কেনে। ছুরিটি প্যান্টের ভেতর নিয়ে সে রাজপালের দোকানে যেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। রাজপাল দোকানে এলে ইলমুদ্দিন তাকে খুন করে। এভাবেই রাজপাল নামক সনাতনী বীর ইতিহাসে অমর হয়ে থাকলেন।  

    এরপর পুলিশ ইলমুদ্দিনকে ঘটনাস্থল থেকেই হাতে-নাতে প্রেপ্তার করে।

    কোর্টে ইলমুদ্দিন নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। বিবাদী পক্ষ তার নির্দোষিতার পক্ষে দুজন মিথ্যা সাক্ষীও উপস্থাপন করে। ( ইলমুদ্দীন ঘটনার দিন অন্য জায়গায় ছিলেন এমন)। কিন্তু কোর্ট ইলমুদ্দিনের ফাঁসির আদেশ দেয়।

    মামলা যখন হাইকোর্টে যায় তখন ইলমুদ্দিনের পক্ষে মামলা লড়েন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। মৃত্যুদন্ড আদেশকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে বদলানোর চেষ্টা করেও পারেননি জিন্নাহ।

    ফাঁসি কার্যকর হবার পর স্যার আল্লামা ইকবাল ও সৈয়দ দিদার আলি শাহ এর মত সম্ভ্রান্তরাসহ কয়েক লক্ষ মুসলিম লাহোরে ইলমুদ্দিনের জানাজায় অংশ নেন।

    এখানে কয়েকটা বিষয় লক্ষ্যনীয় যে,

    ১। মুহাম্মদকে নিয়ে স্যাটায়ারধর্মী বই প্রকাশের কারণে মুসলমান কর্তৃক হিন্দু প্রকাশক খুন হলেও, কৃষ্ণকে ও সীতাকে নিয়ে স্যাটায়ারধর্মী বই প্রকাশের কারণে হিন্দুরা পালটা খুন করেনি।এই সমস্যার সমাধান প্রখ্যাত ভারতীয় চ্যানেল মালিক এবং একমাত্র হালাল স্ট্যান্ডাপ কমেডিয়ান ডাঃ জাকির নায়েক অনেক আগেই দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছিলেন-
    এটাই প্রমাণ করে তাঁরাও (বিধর্মীরা) তাঁদের ধর্মকে সত্য বলে মনে করেন না, তাই রক্ষা করতেও এগিয়ে আসেন না। আমরা আমাদের ধর্মকে সত্য বলে জানি বলেই রক্ষার্থে এগিয়ে আসি!

    ২। খুনীকে মুসলিম কমিউমিনিটি শহীদের উপাধি দেন। লেখার বিপরীতে লেখা চলতে পারে, কিন্তু লেখার বিপরীতে খুন করা যে খারাপ কাজ সেটা অনুধাবন করার ক্ষষমতা মুসলিম কমিউনিটি ছিলোনা (এখনো নেই)। এমনকি তখনকার নামকরা সকল মুসলিমরা এ হত্যার সমর্থক ছিলেন। 

    তাই মুসলিম শিক্ষিত হোক আর অশিক্ষিত হোক এরা সকলেই উগ্রপন্থী ভেতরে ভেতরে।


    ৩। খুনি ধরেই নিয়েছে মোহাম্মদ (সাঃ) একজন চরিত্রবান মানুষ ছিলেন। তাই “রঙ্গিলা রাসুল” নামক পুস্তকের কথাগুলো আসলে সত্য কিনা তা যাচাই করার প্রয়োজন মনে করেনি। যেমনটি বেশিরভাগ মুসলমান করে থাকে।

    ৪। প্রকাশক রাজপাল নিজের জীবন দিয়ে হলেও লেখকের নাম প্রকাশ করেন নি। তার বলিদানও বৃথা যায়নি। তার বলিদানের কারণেই আজ আমরা এই গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করছি এবং হাজার হাজার মানুষ আজও এই গ্রন্থ আগ্রহের সাথে পড়েন।

    ৫। মুসলিমদের প্রতি মহাত্মা গান্ধীর অনৈতিক সমর্থন।

    [বিদ্রঃ বাংলা ট্রিবিউন এই ঘটনা সম্পর্কে ভুল তথ্য ছেপেছে

    "সজীব ওয়াজেদ, জাফর ইকবাল এবং ‘স্পর্শকাতর’ ব্লগার ইস্যু" প্রবন্ধে লেখক আনিস আলমগীর লিখেছেন,

    ‘রঙ্গিলা রাসুল’। এই নামে ১৯৩৫ সালে কলকাতা থেকে জনৈক দীনেশ ভট্ট একটি বই লিখেন। প্রকাশের পরই তোলপাড় শুরু হয় চারদিকে। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ চলতে থাকে। আন্দোলন-মিছিল নিত্য ঘটনা। একদিন মিছিল যাচ্ছিল সোনাগাছির বিখ্যাত নিষিদ্ধ পল্লীর পাশ দিয়ে। পতিতালয়ের এক পাঠান দারোয়ান মিছিলের কারণ জানতে চাইল তাদের কাছে। এই অবাঙালিকে বলা হলো- মুসলমানদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (স.)-কে কটাক্ষ করে একজন হিন্দু বই লিখেছেন- তার প্রতিবাদে এই মিছিল। অল্প দিনের মধ্যেই উপর্যুপরি ছুরির আঘাতে খুন হন দীনেশ ভট্ট। তাকে হত্যা করে আর কেউ নয়, সোনাগাজী পতিতালয়ের সেই দায়োয়ান।

    দেখুন, সারাদিন যিনি বেশ্যাদের পাহারা দিতেন, তারও ধর্মানুভূতি এতই প্রখর যে, ধর্মের কারণে সে মানুষ খুন করতে দ্বিধা করেনি। নিজে ধর্ম পালন করে কি না সেটা বড় নয়, ধর্মানূভূতিতে টইটুম্বুর।]


    তথ্যসূত্রঃ