• সর্বশেষঃ

    ধর্মের আড়ালে অধর্মের বন্যা - আচার্য্য ব্রহ্মদত্ত জী


    আপনি বলিবেন যে, আজ সংসারে বহু মন্দির, বহু মসজিদ, বহু গীর্জাঘর, বহু গুরুদ্বার, বহু তীর্থস্থান, বহু ধর্মগুরু থাকিলেও অশান্তি কেন ? সংসারে এত সকল অন্যায় অত্যাচার, পাপাচারের বৃদ্ধি কেন হইতেছে ? তাহা হইলে এই সকল কি ব্যর্থ ? 

    সেজন্য নিবেদনঃ
    আজ ধর্মের আড়ালে অধর্ম চলিতেছে । অথবা এরূপ বলা যাইতে পারে- অধর্ম, ধর্মের চাদরে গা ঢাকিয়া বসিয়া আছে, ঘুরিয়া বেড়াইতেছে । স্পষ্টিকরণ একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে বুঝিতে পারিবেনঃ

    দুই নবযুবতী রাত্রে ভ্রমণ করিবার জন্য বাহির হইল । পরন্তু ভোর বেলায় উভয়েই বস্ত্র খুলিয়া সরোবরে স্নান করিতে ছিল । ধর্মরূপী যুবতী সুন্দরী, সরলা, উদার এবং পরোপকারিণী ছিল এবং অধর্মরূপী যুবতী কুরূপা কুটিলা ছিল । সে শীঘ্রই স্নান করিয়া পাড়ে আসিল এবং ধর্মের বস্ত্র পড়িয়া আগে চলিয়া গেল । এখানে ধর্মরূপী যুবতী আসিয়া দেখিল যে, আমার বস্ত্র পড়িয়া অধর্মরূপী যুবতী দৌড়াইয়া যাইতেছে । ধর্ম বেচারী আর কি করিবে, নিজ লজ্জা নিবারণের জন্য বাধ্য হইয়া অধর্মের বস্ত্র পড়িল । তখন হইতে ধর্ম, অধর্মের বস্ত্র পরিধান করিয়া ঘুরিয়া বেড়াইতেছে । এই জন্য আজকার সমাজে ধর্মের আড়ালে অধর্মই কার্য্য করিতেছে । সেই সকল দাদ, চুলকানি, বেমানানকে যদি ঢাকিতে হয় তাহা হইলে সুন্দর বস্ত্র দ্বারা ঢাকিয়া দিন সকল কুরূপতা আড়াল হইয়া যাইবে । এইরূপে সমাজে যত পাপ, ভন্ডামি, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, ব্যভিচার ইত্যাদি সকলকেই ধর্মের আড়ালে অবস্থান করিতেছে । মনুষ্য যতই চাতুরতা করুক না কেন অবশেষে পাপ, কর্মের ফল কখনও শুভ হইতে পারে না । “অবশ্যমেব ভোক্তব্যং কৃতং কর্ম শুভাশুভম্” । শুভাশুভ কর্মের ফল তো প্রাপ্ত করিতেই হইবে । 

    বেদ খুবই সুন্দর মন্ত্র আছে— 
    অসদ্ভূম্যাঃ সমভবদ্ তদ্ দ্যামেতি মহদ্ব্যচঃ । 
    তদ্বৈ ততো বিধুপায়ৎ প্রত্যক্ কর্ত্তারমৃচ্ছতু । (অথর্ব০ ৪।১৯।১৬) 

    অসদ্ ভূম্যাঃ সমভবৎ = অসৎ কার্য ভূমি হইতে হইয়া থাক, তদ্ মহদ্ ব্যচঃ = তাহা মহাবিস্তার লাভ করিয়া, দ্যাম্ এতি = আকাশে গমন করে, তৎ বৈ ততঃ ঋচ্ছতু = পুনরায় কর্ত্তাকে প্রাপ্ত হইয়া থাকে। 
    কথাটির তাৎপর্য্য এই যে, কর্ত্তা যেরূপ কর্ম করুক না কেন সেইরূপ ফল সে পুনরায় প্রাপ্ত করে । এই সংসার প্রত্যেক মানুষের গুণ, কর্ম, স্বভাব একে অপরের অপেক্ষা ভিন্ন, ইহাই কারণ যে, যবে থেকে সৃষ্টি রচিত হইয়াছে তখন হইতে আজ পর্যন্ত এবং পরবর্তি কালেও উত্তম এবং অধম ব্যক্তিগণ অবশ্যই বিদ্যমান থাকিবেন । এইরূপ নয় যে সত্য যুগে কেবল সত্যবাদী ব্যক্তিগণ ছিলেন । ত্রেতা, দ্বাপরেও উত্তম অধম অবশ্যই রহিয়াছিলেন । ব্রাহ্মণ গ্রন্থে এক স্থানে বর্ণিত আছে যে, যে রূপ মনুষ্য যেখানে যেখানে গমন করে সেখানে সেখানে তাহার ছায়াও গমন করে, পৌঁছাইয়া যায় । ঠিক সেইরূপে মনুষ্য যে সকলই কার্য্য করে তাহার ফলও তাহার সাথেই থাকে ।এই জন্য মনুষ্যদিগের সদা ধর্মই করা কর্তব্য ।

    দুষ্ট ভাব, যাহা মনুষ্য মাত্রের জন্য দুঃখের বীজ, সদা দুঃখ উৎপন্ন করিয়া থাকে, এই জন্য দুষ্টভাবকে ত্যাগ করাই সফলতার কারণ । বেদ, ত্যাগ, যজ্ঞ, নিয়ম এবং তপ এই সকল শুভ কার্য্য দুষ্ট ভাবযুক্ত ব্যক্তিকে সিদ্ধি প্রদান করিতে পারিবে না । এইরূপ মনুস্মৃতিতে উল্লেখ করা হইয়াছে । 

    মহাভারতে বর্ণিত হইয়াছে যে, ধৃতরাষ্ট একবার অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন । মহারাজ রাজগুরু বিদুর কে আহ্বান করিলেন এবং নিজ কল্যাণ প্রাপ্ত করিবার জন্য তাঁহার নিকট পরামর্শ চাহিলেন । বিদুর উত্তর করিলেন— হে রাজন্ ! দুষ্ট দুর্যোধন, দুঃশাসন, শুকুনি ইত্যাদি দিগের মাঝে থাকিয়াও আপনি কল্যাণের আশা করেন ? দুষ্ট মনুষ্যদিগের মাঝে থাকিয়া, সকল দুষ্ট বিচার যুক্ত আচরণ করেয়া ব্যক্তি কখনও কল্যাণ প্রাপ্ত করিতে পারিবে না । দুর্যোধনেন সংসর্গেণ ভীষ্মো গোহরণে গতঃ । দুষ্টমিতি দুর্যোধনের পক্ষে থাকিয়া আদিত্য ব্রহ্মচারী ভীষ্ম পিতামহের ন্যায় যেরূপ জ্ঞানবান পুরুষ বিরাট নগরীতে গোহরণের জন্য পিছুপা হন না । ইহা কি দুষ্ট দিগের পরিণাম নয় ? যেরূপ অম্লযুক্ত পাত্রকে উত্তম রূপে শুদ্ধ না করিয়া দুগ্ধ রাখা যায় না উত্তম দুগ্ধও ফাটিয়া যাইবে । ঠিক এইরূপ দুষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে আসিয়া উত্তম ব্যক্তিও সঙ্গদোষের কারণে নষ্ট হইয়া যায়, অধার্মিক হইয়া যায় । যদ্যপি এই নিয়ম সর্বত্র প্রযুক্ত হয় না, কখনও কখনও ইহাও দেখা গিয়াছে যে— অধার্মিক ব্যক্তি ধার্মিক ব্যক্তির আচার, বিচার, ব্যবহার ইত্যাদির দ্বারা প্রভাবিত হইয়া জীবনকে পাপপংক হইতে দূরে সুরাইয়া সদাচরণের সাথে যুক্ত হইয়া যান । বেদে দুষ্টভাব, দুষ্ট প্রবৃত্তি হইতে বাঁচিবার জন্য ভক্ত প্রার্থনা করিয়াছেন যে—

    ও৩ম্ পরিমাগ্নে দুশ্চরিতাদ্ বাধস্বা মা সুচরিতে ভজ । 
    উদায়ুষা স্বায়ুষোদস্থামমৃতামনু ।। (যজু০ ৪।২৮ )

    অর্থাৎ, হে প্রকাশস্বরূপ পরমাত্মন্ ! আপনি আমাকে দুষ্টাচরণ হইতে পৃথক করিয়া উত্তম ধর্মাচরণযুক্ত ব্যবহারে নিয়োজিত করিবেন যাহাতে আমি জীবন-মুক্তমালা অথবা মোক্ষ প্রাপ্ত বিদ্বান্ গণের ন্যায় হইতে পারিব অথবা মোক্ষরূপী আনন্দ কে প্রাপ্ত করিতে পারিব । ইহার দ্বারা স্পষ্ট হয় যে জীবন মুক্ত হইতে গেলে সত্যাচরণের অনুষ্ঠান করা অনিবার্য্য । কোনও ইংরেজী সাহিত্যকার খুব সুন্দর লিখিয়াছেন— Man Can not remains stationary . He must either improve or impair.

    অর্থাৎ, মনুষ্য কখনও একই রূপে থাকিতে পারেনা, হয় সে উন্নতির দিকে অগ্রসর হইবে অথবা অবনতির দিকে ঝুঁকিবে । এইজন্য নিন্দা অপমান দূর করিবার জন্য মনকে সদা ধর্মযুক্ত ব্যবহারের সাথে যুক্ত করা কর্তব্য । ধর্ম কি ? এই প্রশ্নের উত্তর দিবার চেষ্টা সংসারের অনেক তত্ত্বদর্শীগণ, ধর্মপ্রচারকগণ, ঋষিমুনিগণ, সাধু সন্ন্যাসীগণ করিয়াছেন । কেহ কেহ ইহাকে যথার্থ স্থান দিবার জন্য সমাজের হিতের পক্ষে উল্লেখ করিয়াছেন । কেহ কেহ ইহাকে বাহিরের তপ-জপ এবং কর্মকাণ্ডের সহিত সম্বোধন করিয়াছেন । কেহ কেহ ইহাকে নৈতিকতার পর্যায় মান্য করিয়াছেন । কেহ তো ইহাকে কেবল আধ্যাত্মিক বিষয় সমূহের সহিত সম্বন্ধিত মান্য করিয়াছেন । কতিপয় ব্যক্তি তো ইহার অন্তর্গত সমস্ত জীবন এবং তাহার কার্য্য-কলাপ কে গ্রহণ করিয়া লয়েন । এই বিবাদ এবং বিভিন্নতা হইতে এই প্রমাণিত হয় যে ইহার ব্যাপকতা, সুক্ষ্মতা, জটিলতা স্বয়ং সিদ্ধ । মহাভারতের যুধিষ্ঠির ইহার খুব সুন্দর উত্তর বুঝাইতে চেষ্টা করিয়াছেন । 

    তর্কো প্রতিষ্ঠঃ শ্রুতয়ো 
    বিভিন্নানৈকোমুনির্য়স্যবচঃ প্রমানম্ ।
    ধমস্য তত্ত্বং গুহায়ং মহাজনো য়েনো গতঃ স পন্থাঃ ।। 

    অর্থাৎ, ধর্মের বিষয়টি খুব গহন । ইহা তর্ক দ্বারা জানিতে পারা যায় না, ধর্ম শাস্ত্রের দ্বারাও নয় এবং কোন ঋষি মুনির বানী হইতেও নয় । অপিতু যে পথে মহাজন গমন করেন তাহাই ধর্ম । বাস্তবে এই উক্তিটি সর্বসাধারণের জন্য অত্যন্ত মহত্ত্ববপূর্ণ । কেননা সর্বসাধারণের জন্য বেদশাস্ত্র, দর্শন, ব্যাকরণ ইত্যাদি শাস্ত্রের গভীর জ্ঞান আয়ত্তের বাহিরে তাহারা প্রায়ই ইহা বুঝিয়া থাকেন যে, অমুক মহাপুরুষের আচার, বিচার, রহন, সহন, দৈনিক কর্ম, স্বাধ্যায়, সাধনা সঠিক । অতএব তাঁহার জীবন দিব্য তাঁহাকে অনুকরণ করা উচিৎ । ভগবান শ্রীকৃষ্ণও বলিয়াছেনঃ

    যদ্যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তদেবেতরো জনঃ।
    স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ততে ।। 
    (গীতা ৩/২১)

    অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যেরূপ আচরণ করেন সাধারণ ব্যক্তি সেইরূপ অনুসরণ করে । উপনিষদে ঋষি মাতা পিতা তথা আচার্য্যের জন্য খুবই মার্মিক কথা লিখিত হইয়াছে , মাতা পিতা অথবা আচার্য্য নিজ পুত্র পুত্রী দিগকে তথা আচার্য্য নিজ শিষ্যগণকে বলিবেন যেঃ

    যান্যস্মাকং সুচরিতানি তানি ত্বয়োপাস্যানি নো ইতরাণি । 

    অর্থাৎ, আমাদিগের মধ্যে যাহা সুচরিত সেই সকলকে তো তোমরা অবশ্যই গ্রহণ করিবে পরন্তু আমাদের মধ্যে যে সকল নিন্দনীয় দূর্গুণ সেই সকলের গ্রহণ কদাপি করিও না । ইহার দ্বারা প্রমাণ হয় যে ধর্মকে আত্মসাৎকারী ধর্মাত্মা পুরুষের কেবল তর্ক দ্বারা ধর্মের ব্যাখ্যাকে অপরের নিকট পৌঁছাইতে চাহেন, সমাজ তাহাদিগকে অধিক গুরুত্ব দেয় না । এই জন্য আমরা বলিতে পারি যে, ধর্মের দ্বারা যখন আমার জীবন কে রূপান্তরণ করিয়া থাকি তখন যেরূপ রামের সম্বন্ধে উক্তি থাকে রামো বিগ্রহবান্ ধর্মঃ। রাম সাক্ষাৎ ধর্মের প্রতিমূর্তি । সেইরূপ আমাদিগের সম্বন্ধেও এই উক্তি প্রয়োগ হইতে পারে যখন আমরা সমগ্রতার সাথে ধর্মকে আত্মসাৎ করিয়া নিজ তেজস্বী জীবন দ্বারা সৃষ্টির মার্গ দর্শক হইয়া থাকি । এই জন্য ধর্ম তাহাকেই বলিব যাহা মনুষ্য-মনুষ্যের মাঝে প্রেমের, সৌহার্দ্রের, অহিংসার, ভাতৃত্ব বোধের পরিবেশ উৎপন্ন করিবে । ধর্ম তাহাকেই বলিব যাহা মনুষ্য-মনুষ্যদিগকে অধিকাধিক সম্মুখে আনিবে এবং ধর্ম সেই হইবে যাহা আমাদিগের মধ্য হইতে হিংসা, দ্বেষ, লোভ, মোহ, স্বার্থপরতা, সংকীর্ণতা, অবিশ্বাস এবং মিথ্যা ধারণা গুলিকে উন্মূলন করিয়া আমাদের মধ্যে নূতন জ্যোতি, নবীন আলোকের কিরণ বিকীর্ণ করিবে আমাদিগকে নব জাগৃতি এবং আত্মবল প্রদান করিবে ।

    ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ এর পাঠ আমাদিগের বোধগম্য হউক । এইরূপ তথাকথিত ধর্মের নামে মতামত, জাতিবাদ, সম্প্রদায় ভিত্তিক শিক্ষা আমাদের নয়, যাহা মানবকে পারস্পরিক ঈর্ষা, দ্বেষ, ঘৃণা, বৈরতা-বিরোধ, হিংসা-সংঘর্ষ এবং বৈমনস্য কে প্ররোচিত করে । বাস্তবে তাহা ধর্ম হইতেই পারে না যাহারা দ্বারা দৃষ্টির বিস্তার অস্পষ্ট এবং সংকীর্ণ হয় । ধর্ম মানব সমাজকে স্বচ্ছ দৃষ্টি প্রদান করে তথা সংকীর্ণতা হইতে বাহিরে টানিয়া সূক্ষ্ম এবং দূরগামী দৃষ্টি প্রদান করিয়া থাকে । মনু মহারাজ বলিয়াছেন—ধর্মের দ্বারাই প্রজার ধারণ, পোষণ, রক্ষণ হইয়া থাকে । “ধর্মো ধারয়তে প্রজাঃ” ধর্মের এহেন উচ্চ স্তরের মহিমা আছে । ঋষি দয়ানন্দ ‘স্বমন্তব্যামন্তব্য প্রকাশ’ পুস্তকে উদ্ধৃত করিয়াছেন- পক্ষপাত রহিত ন্যায়াচরণ তথা সত্যভাষণ ইত্যাদি সদাচারকেই ধর্ম মান্য করা হয় এবং ধর্ম তথা মনুষ্যত্বের পর্যায় বলা হইয়াছে । মহর্ষি স্বয়ং লিখিয়াছেন যে- পক্ষপাত রহিত ন্যায়াচরণ সত্যভাষণ ইত্যাদি যুক্ত যে সকল ঈশ্বরের আজ্ঞা রহিয়াছে যাহা সকল বেদের অবিরূদ্ধ, তাহাকেই ধর্ম মান্য করি । সত্যার্থ প্রকাশ পুস্তকে ঋষি উদ্ধৃত করিয়াছেন- এই কার্য্যে যতই নিদারুন দুঃখ আসুক না কেন প্রাণও যদি চলিয়া যায়, পরন্তু মনুষ্যতা ধর্ম হইতে পৃথক হইতে কখনই হইবে না ।