• সর্বশেষঃ

    গীতা সমীক্ষাঃ পর্বঃ২ গীতায় কোন যজ্ঞ অবশ্য করতে বলা হয়েছে? বর্তমানে প্রচলিত "নামযজ্ঞ" কি গীতা সমর্থন করে?


    পুণ্য লাভ ও মুক্তি লাভের জন্য যজ্ঞ করার বিকল্প নেই। 
    এ বিষয়ে গীতায় বলা হচ্ছেঃ

    যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজো যান্তি ব্রহ্ম সনাতনম্‌ ।
    নায়ং লোকোঽস্ত্যযজ্ঞস্য কুতোঽন্যঃ কুরুসত্তম ।। (গীতাঃ৪/৩১)

    পদার্থঃ কুরুসত্তম(হে কুরুশ্রেষ্ঠ অর্জুন!) যজ্ঞশিষ্টামৃতভুজঃ(যজ্ঞের পরিণামরূপ জ্ঞানামৃত ভোগকারী যোগিগণ) সনাতনম্‌(সনাতন) ব্রহ্ম(পরমব্রহ্ম পরমাত্মাকে) যান্তি(প্রাপ্ত হন) অযজ্ঞস্য(যজ্ঞরহিত পুরুষের) অয়ম্‌(এই) লোকঃ(মনুষ্যলোক[সুখপ্রদ]) ন,অস্তি(হয় না) অন্যঃ(পরলোক) কুতঃ(কীপ্রকারে[সুখপ্রদ হবে])

    অনুবাদঃ হে কুরুশ্রেষ্ঠ অর্জুন! যজ্ঞের পরিণামরূপ জ্ঞানামৃত ভোগকারী যোগিগণ সনাতন পরমব্রহ্ম পরমাত্মাকে প্রাপ্ত হন। আর যজ্ঞরহিত পুরুষের এই মনুষ্যলোক সুখপ্রদ হয় না পরলোক কীপ্রকারে সুখপ্রদ হবে?

    যজ্ঞদান্তপঃকর্ম ন ত্যাজ্যং  কার্যমেব তৎ। (গীতা ১৮/৫)
    যজ্ঞ, দান ও তপস্যা ত্যাগ করার যোগ্য নয়, তা অবশ্যই কর্তব্য।

    তাই সবার জন্য যজ্ঞ করা আবশ্যক। কিন্তু এই যজ্ঞ  সম্পর্কে কিভাবে জানা যাবে? যজ্ঞের বিধিই বা কোথায় পাওয়া যাবে? এ বিষয়ে গীতা বলছেঃ

    এবং বহুবিধা যজ্ঞা বিততা ব্রহ্মণো মুখে ।
    কর্মজান্‌ বিদ্ধি তান্‌ সর্বানেবং জ্ঞাত্বা বমোক্ষ্যসে ।।(গীতাঃ৪/৩২) 

    পদার্থঃ এবম্‌(এইরূপ) বহুবিধাঃ(বহুবিধ) যজ্ঞাঃ(যজ্ঞ) ব্রহ্মণোঃ(বেদের) মুখে(বাণীতে) বিততাঃ(বিস্তারিত বলা হয়েছে) তান্‌(সেই) সর্বান্‌(সবকে) কর্মজান্‌(কর্মজনিত) বিদ্ধি(জানো) এবম্‌(এইপ্রকার) জ্ঞাতা(জেনে তুমি) বিমোক্ষ্যসে(মুক্তি লাভ করবে)।

    অনুবাদঃ এইরূপ বহুবিধ যজ্ঞের কথা বেদের বাণীতে বিস্তারিত ভাবে বলা হয়েছে। এইসবগুলিকে তুমি কর্মজনিত বলে জানবে। এইপ্রকার জেনে তুমি মুক্তি লাভ করবে।
    অর্থাৎ, বেদেই বহুপ্রকার যজ্ঞ সম্পর্কে জানা যাবে, যজ্ঞের বিধি-বিধান পাওয়া যাবে। এবং বেদের এই বিধি-বিধান অনুসরণ করেই যজ্ঞ করতে হবে। 

    এখন প্রশ্ন ওঠে বেদের বিধি এবং বেদমন্ত্র ব্যাতিত যদি কোনো ব্যাক্তি যজ্ঞ করে তবে তার ফল কিরূপ হবে?
    গীতায় বলা হয়েছেঃ

    বিধিহীনমসৃষ্টান্নং মন্ত্রহীনমদক্ষিণম্‌ ।
    শ্রদ্ধাবিরহিতং যঞ্জং তামসং পরিচক্ষতে ।। (গীতাঃ১৭/১৩)

    পদার্থঃ বিধিহীনম্‌(শাস্ত্রবিহীন) অসৃষ্টান্নম্‌(অন্নদান রহিত) মন্ত্রহীনম্‌(মন্ত্রহীন) অদক্ষিণম্‌(দক্ষিণাশূন্য) শ্রদ্ধাবিরহিতম্‌(শ্রদ্ধারহিত) যজ্ঞম্‌(যজ্ঞকে) তামসম্‌(তামস) পরিচক্ষতে(বলা হয়)

    অনুবাদঃ শাস্ত্রবিহীন অন্নদান রহিত মন্ত্রহীন দক্ষিণাশূন্য এবং শ্রদ্ধারহিত যজ্ঞকে তামসিক যজ্ঞ বলা হয়।

    এই তামসিক যজ্ঞ মানুষের ভেতর তমোগুণের জন্ম দেয়। এই যজ্ঞ দ্বারা সমাজের কোনো কল্যান হয় না। বরং সমাজ অকল্যানের পথে ধাবিত হয়। তাই এই ধরণের যজ্ঞ সর্বদা পরিত্যাজ্য। 

    এখানে জ্ঞাতব্য বিষয় – সনাতন শাস্ত্রে কোনগুলো মন্ত্র হিসেবে বিবেচিত হয়? 
    উত্তরঃ একমাত্র বৈদিক সাহিত্যের ক্ষুদ্রতম ভাগকে তথা সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদের ক্ষুদ্রতম অংশকে মন্ত্র বলা হয়। বাকি সকল শাস্ত্র; যেমনঃ গীতা, পুরাণ ইত্যাদির ক্ষুদ্রতম অংশকে বলা হয় শ্লোক।

    নিরুক্তকার যাস্ক নিরুক্তের ৭/১২ তে বলেছেন, "মন্ত্র মননাৎ" অর্থাৎ মননে মন্ত্র হয়।

    এখানে মনন শব্দের অর্থ মনে সৃষ্টি। অর্থাৎ কোনো বাক্য, পদ বা পদ্য যখন ঋষিদের মনে সৃষ্টি হয় তখন তাকে মন্ত্র বলে। এখন প্রশ্ন হতে পারে, এখানে মন বলতে ঋষিদের মনকেই বোঝানো হয়েছে তার প্রমাণ কি?

    নিরুক্তে বলা আছে যে - ঋষিদের এরূপ প্রসংশা যে, নানা প্রকার অভিপ্রায় দ্বারা ঋষিদের মন্ত্রদর্শন হয় (ঋষিণাং মন্ত্রদৃষ্টয়ো ভবন্তি - নিরুক্ত ৭।৩)।
     ঋষিদের নানা প্রকার দৃষ্টির তাৎপর্য এই যে, তাদের বৃহৎ পুরুষার্থ দ্বারা মন্ত্রের ঠিক ঠিক প্রকার সাক্ষাৎ হয়।

    মন্ত্র আমরা তাকেই বলবো যা ঋষিদের মনে ঈশ্বর প্রকাশ করেন। আর বেদ যেহেতু ঈশ্বর সৃষ্ট আর ঋষি কর্তৃক দৃষ্ট তাই বেদের পদ্যকে মন্ত্র বলে।

    এখান থেকে প্রমানিত হয় একমাত্র বেদমন্ত্র দ্বারা যজ্ঞ করার কথাই গীতা নির্দেশ করে। 

    এখন বিবেচনার বিষয় বর্তমানে প্রচলিত “হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র” দ্বারা যজ্ঞ করা কতটা যুক্তিযুক্ত? 
    “হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র” কি আসলেই কোনো মন্ত্র? এই মন্ত্রের উৎস কি? 

    এ বিষয়ে বলা হয়ে থাকে যে - এটা কলিসন্তরণ উপনিষদের মন্ত্র। কিন্তু কলিসন্তরণ উপনিষদ বলতে কি আসলেই কোনো উপনিষদ আছে? 

    এবিষয়ে উল্লেখ্য যে সংহিতা ৪ টি। ঋগ্বেদ সংহিতা, সামবেদ সংহিতা, যর্জুবেদ সংহিতা এবং অথর্ববেদ সংহিতা। এ ব্যাতিত আর কোনো সংহিতা নেই। এবং উপনিষদ ১২টি। ঈশ, কেন, কঠ, প্রশ্ন, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য, তৈত্তিরীয়, ঐতেরেয়, শ্বেতাশ্বতর,ছান্দোগ্য, বৃহাদারণ্যক ও কৌষীতকী। তুলনামূলক আধুনিক কালে বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করে তার নামের সাথে সংহিতা উপনিষদ ইত্যাদি যোগ করে বেদের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেমন মোঘল আমলে আল্লোপনিষদ নামে এক পুস্তক রচনা করা হয়, এবং সেখানে আল্লাকে সর্বশক্তিমান হিসেবে দেখানো হয়। এসব করার মূল উদ্দেশ্য ছিলো এদেশের মানুষকে ধর্মান্তরিত করা। শুধু মোঘলরা নয় বিভিন্ন গুরু এবং সম্প্রদায় তাদের মত প্রতিষ্ঠা করার জন্য নতুন নতুন গ্রন্থ রচনা করে সংহিতা উপনিষদ ইত্যাদি নামে চালিয়ে দিয়েছে। এই সকল উপনিষদ ও সংহিতা মোটেও আসল উপনিষদ সংহিতা নয়। প্রকৃত পক্ষে সংহিতা ৪টি এবং উপনিষদ ১২টি। এ বিষয়ে সকল পণ্ডিত একমত। 
    তাই কলিসন্তরণ উপনিষদ মোটেও প্রাচীন বৈদিক উপনিষদ নয়। এবং এতে প্রকৃত পক্ষে কোনো “মন্ত্র” নেই। কলিসন্তরণ উপনিষদ যে মোটেও প্রাচীন উপনিষদ নয় তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো সেখানে বর্ণীত কৃষ্ণের নাম। কারণ সকল উপনিষদই মহাভারতের যুদ্ধের বহু পূর্বে দৃষ্ট। তাই কলিসন্তরণ উপনিষদ নামের কোনো উপনিষদ আদৌ বিদ্যমান থাকা সম্ভব নয়।

    এখন যদি ধরে নেই কলিসন্তরণ উপনিষদ আসলেই একটি প্রাচীন উপনিষদ; তবুও কি "হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র" মন্ত্র বলে বিবেচিত হবে? আদৌ কি কলিসন্তরণ উপনিষদে এমন কোনো মন্ত্র আছে? 

    “হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।
    হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।।” (কলিসন্তরণ উপনিষদ  ২)

    এই মন্ত্রের লাইন দুইটি বর্তমানে প্রচলিত “হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্রে”র ঠিক উল্টো।

    তাই বলা যায় বর্তমানে প্রচলিত “হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র” কোনো মন্ত্রই নয়। যেহেতু এটা মন্ত্রই নয় তাই “হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র” নামক নবগঠিত শ্লোকের দ্বারা যেসব যজ্ঞ করা হয় তা সকলই তামসিক যজ্ঞ। এবং এই যজ্ঞ দ্বারা মানবজাতির কোনো কল্যান হতে পারে না। বরং অকল্যান হয়। 

    আপনি কি বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণপূর্বক বৈদিক বিধি মেনে যজ্ঞ করবেন; নাকি বেদমন্ত্র বর্জিত “নামযজ্ঞ” করবেন?
    স্বয়ং বিচার করুন।