গীতা সমীক্ষাঃ পর্বঃ৩ গীতায় কি বেদবিধি আনুসারে ধর্ম-কর্ম করতে নিষেধ করা হয়েছে?
চিত্রঃ বৈদিক আর্য সমাজ
বর্তমানে কতিপয় বৈষ্ণব ও গুরুবাদী গোষ্টীর লোকেরা প্রমান করতে ব্যাস্ত যে বেদ বর্তমান যুগের জন্য নয়। তাদের মত প্রতিষ্ঠার জন্য তারা গীতার বিকৃত ব্যখ্যাও করে থাকে। এরা নিম্নোক্ত শ্লোক সমূহকে হাতিয়ার করে প্রচার করে যে গীতায় বেদবিধি আনুসারে ধর্ম-কর্ম করতে নিষেধ করা হয়েছে।
কিন্তু আসল সত্য কি তা আপনারা নিজেরাই বিচার করবেন এই লেখাটি পড়ার পর।
যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ।
বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদস্তীতি বাদিনঃ।। (৪২)
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফল্প্রদানম্।
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি।। (৪৩)
ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্।
ব্যাবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে।। (৪৪)
(গীতাঃ২/৪২-৪৪)
পদার্থঃ [হে পার্থ], অবিপশ্চিতঃ (অল্পবুদ্ধি,অবিবেকী) বেদবাদরতাঃ (বেদোক্ত কাম্যকর্মের প্রশংসাবাদে অনুরক্ত) অন্যৎ ন অস্তি ইতি বাদিনঃ (তদ্ভিন্ন আর কিছু নাই এই মতবাদী) কামাত্মানঃ (কামনাকুলচিত্ত) স্বর্গপরাঃ (স্বর্গই যাদের পরম পুরুষার্থ এরূপ ব্যক্তিগণ) জন্মকর্ম-ফলপ্রদানং (জন্মরূপ কর্মফল প্রদানকারী) ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি (ভোগ ও ঐশ্বর্য লাভের উপায়ভূত) ক্রিয়াবিশেষবহুলাং (বিবিধ ক্রিয়া-কলাপের প্রশংসাসূচক) যাম্ ইমাং পুষ্পিতাং বাচং (এই যে শ্রুতিমনোহর বাক্য) প্রবদন্তি(বলে) তয়া (সেই বাক্যদ্বারা) অপহৃতচেতসাং (বিমুগ্ধচিত্ত) ভোগৈশ্বর্য, প্রসক্তানাং (ভোগৈশ্বর্যে আসক্ত বযক্তিগণের) ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ ( কার্যাকার্যের নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি) সমাধৌ ন বিধীয়তে(সমাধিস্থ হয় না, এক বিষয়ে স্থির হয় না)।
অনুবাদঃ হে পার্থ, অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণ বেদের কর্মকাণ্ডের স্বর্গফলাদি প্রকাশক প্রীতিকর বাক্যে অনুরক্ত, তাহারা বলে বেদোক্ত কাম্য-কর্মাত্মক ধর্ম ভিন্ন আর কিছু ধর্ম নাই, তাদের চিত্ত কামনা-কলুষিত, স্বর্গই তাহাদের পরম পুরুষার্থ,তাহাদের ভোগৈশ্বর্য লাভের উপায় স্বরূপ বিবিধ ক্রিয়াকলাপের প্রশংসাসূচক আপাতমনোরম বেদবাক্য বলিয়া থাকে। এই সকল শ্রবণ-রমণীয় বাক্যদ্বারা অপহৃতচিত্ত, ভোগৈশ্বর্যে আসক্ত ব্যক্তিগণের কার্যাকার্য-নির্ণায়ক বুদ্ধি এক বিষয়ে স্থির থাকিতে পারে না( ঈশ্বরে একনিষ্ঠ হয় না)।
(ভাষ্যঃ জগদীশ ঘোষ)
ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভাবার্জুন।
নির্দ্বন্দ্বো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান্।। (গীতাঃ ২/৪৫)
পদার্থঃ [হে অর্জুন], বেদাঃ(বেদসমূহ) ত্রৈগুণ্যবিষয়াঃ(ত্রিগুণাত্মক); ত্বং(তুমি) নিস্ত্রৈগুণ্যঃ (ত্রিগুণাতীত, নিষ্কাম) ভব (হও) নির্দ্বন্দ্বঃ(সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্ব-রহিত) নিত্যসত্ত্বস্থঃ (নিত্য সত্ত্বভাবাশ্রিত, অথবা নিত্য ধৈর্যশীল) নির্যোগক্ষম(যোগ ও ক্ষেম রহিত) আত্মাবান্ (অপ্রমত্ত অথবা পরমেশ্বরে নির্ভরশীল) [ভব – হও]।
অনুবাদঃ হে অর্জুন, বেদসমূহ ত্রৈগুণ্য-বিষয়ক, তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও – তুমি নির্দ্বন্দ্ব, নিত্যসত্বস্থ, যোগ-ক্ষেমরহিত ও আত্মাবান্ হও।
উপোরোক্ত শ্লোকসমূহ পড়ে আপাতদৃষ্টিতে আপনার মনে হতে পারে - “বৈদিক ক্রিয়াকর্ম কেবল ভোগৈশ্বর্য লাভের জন্য করা হয়। এর দ্বারা ঈশ্বর প্রাপ্তি হতে পারে না তথা মুক্তি লাভ হতে পারে না। তাই ত্রৈগুণ্য-বিষয়ক বেদ ত্যাগ করে কৃষ্ণ অর্জুনকে নিস্ত্রৈগুণ্য হতে বলছেন।”
কিন্তু আসলে কি কৃষ্ণ অর্জুনকে বেদ ত্যাগ করতে বলেছেন?
“গীতা সমীক্ষা ২”-এ আমরা দেখেছি বৈদিক নিয়মে যজ্ঞ করা অবশ্য কর্তব্য(গীতাঃ৮/১৫) এবং বেদের জ্ঞান মুক্তির উপায়(গীতাঃ৪/৩২)
তাহলে কি গীতা স্ববিরোধী কথা বলছে?
না। মোটেও না। এটা আপনার বোঝার ভুল। বিষয়টি পরিষ্কার হতে হলে একটু বিস্তারিত ব্যখ্যার প্রয়োজন।
বেদের কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডঃ বেদের চার ভাগ। সংহিতা(মূল বেদ), ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা ও ব্রাহ্মণ ভাগ নিয়ে কর্মকাণ্ড এবং আরণ্যক ও উপনিষদ নিয়ে জ্ঞানকাণ্ড। কর্মকাণ্ডে বিভিন্ন যাগযজ্ঞের ব্যবস্থা আছে। আপরদিকে জ্ঞানকাণ্ড হচ্ছে ঈশ্বর তত্ত্ব; ঈশ্বরকে জানার পথ।
[বিদ্রঃ সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ সবখানেই কমবেশি কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড বিদ্যমান]
ত্রৈগুণ্যঃ সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ – এই তিন গুণ; এইগুণগুলো সকাম ব্যক্তিদের ভেতর বিদ্যমান। এই তিন গুণ জড় প্রকৃতির প্রতি আসক্তির বা বন্ধনের কারণ। যা মুক্তি লাভের প্রধান অন্তরায়। (গীতাঃ১৪/৫-১৭)
নিস্ত্রৈগুণ্য হওঃ সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ – এই তিন গুণ হতে মুক্ত হও; অর্থাৎ সকল কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে নিষ্কাম কর্ম করো। এই নিষ্কাম কর্মই মুক্তি লাভের একমাত্র পথ।
নিস্ত্রৈগুণ্য হওয়ার উপায় কি?
উঃ যখন দ্রষ্টা জীব গুণ ভিন্ন অন্য কাহাকেও কর্তা না দেখেন অর্থাৎ প্রকৃতিই কর্ম করে, আমি করি না, ইহা বুঝিতে পারেন এবং তিন গুণের অতীত পরমাত্মারূপ আমাকে জ্ঞাত হন, তখন তিনি আমার পরম ভাব অর্থাৎ ব্রহ্মভাব বা ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন।( গীতাঃ১৪/১৯)
জীব দেহোৎপত্তির কারণভূত এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া জন্মমৃত্যু জরাদুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া অমৃতত্ব অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেন।(গীতাঃ১৪/২০)
এখন প্রশ্ন ওঠে - পরমাত্মাকে জ্ঞাত হওয়ার উপায় কি?
বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব বেদ্যা বেদান্তকৃদ্বেদবিদেব চাহম্। (গীতাঃ১৫/১৫)
আনুবাদঃ আমিই বেদসমূহের একমাত্র জ্ঞাতব্য আমিই(অর্থাৎ পরমাত্মা), বেদান্তের কর্তা এবং বেদবেত্তা ও আমিই।
আবার দেখুন, সর্বং কর্মাখিলাং পার্থ জ্ঞানে পরিসমাপ্যতে। (গীতাঃ ৪/৩৩)
আনুবাদঃ হে পার্থ! সমস্ত কর্মই পূর্ণরূপে চিন্ময় জ্ঞানে পরিসমাপ্তি লাভ করে।
চতুর্থ আধ্যায়ের পরবর্তি অংশে কর্ম হিসেবে অন্যান্য বিষয়ের সাথে সাথে যজ্ঞেরও উল্লেখ করা হয়েছে। তাই, যজ্ঞের ফলও পূর্ণরূপে চিন্ময় জ্ঞানে পরিসমাপ্তি লাভ আর্থাৎ পরমাত্মাকে জ্ঞাত হওয়ার উপায়।
তাই আমাদের প্রথম কর্তব্য বেদের জ্ঞান লাভ করা এবং যজ্ঞ করা ( যেমনঃ ১) ব্রহ্মযজ্ঞ , ২)দেবযজ্ঞ , ৩) পিতৃযজ্ঞ , ৪)বলিবৈশ্বদেব যজ্ঞ, ও ৫)অতিথি যজ্ঞ ইত্যাদি )। এর দ্বারা আমরা পরমাত্মাকে জানতে পারবো। আর পরমাত্মাকে জানতে পারলেই কেবল নিস্ত্রৈগুণ্য হওয়া সম্ভব। তাই বেদপাঠ ও যজ্ঞ করা আবশ্যকীয়।
কিন্তু প্রশ্নতো থেকেই গেলো - (গীতাঃ২/৪২-৪৫)-এ কেনো বলা হলো - বৈদিক ক্রিয়াকর্ম কেবল ভোগৈশ্বর্য লাভের জন্য করা হয়? এর দ্বারা ঈশ্বর প্রাপ্তি হতে পারে না তথা মুক্তি লাভ হতে পারে না?
উত্তরঃ বেদের জ্ঞানকাণ্ড ও কর্মকাণ্ড সমান ভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ একটিকে ছেড়ে অপরটি সম্ভব নয়। মহাভারতের যুগে নানারূপ ধর্মমতের উদ্ভব ঘটে। আড়ম্বর পূর্ণ যাগ-যজ্ঞই ধর্ম বলে বিবেচিত হতে থাকে। মানুষ স্বর্গ প্রাপ্তির লোভে এসব যাগ-যজ্ঞ করতে থাকে। কিন্তু ঈশ্বর সম্পর্কে তাদের কোনো মাথা ব্যাথা ছিলো না। ঈশ্বরের স্বরূপ যে কি তা তাদের বেশিরভাগ লোকের জানা ছিলোনা।(অশ্বমেধিক পর্ব দ্রষ্টব্য) অর্থাৎ, বেদের জ্ঞানকাণ্ড অবহেলিত ছিলো। আর এই জ্ঞানকাণ্ড রহিত কর্মকাণ্ড ত্রিগুণের জন্ম দেয় অর্থাৎ, কেবলই সকাম কর্মের জন্ম দেয়। যা মুক্তি লাভের প্রধান অন্তরায়। তাই গীতার ঐ ২য় অধ্যায়েরই ৪৮ তম শ্লোকে এ বলা হচ্ছেঃ
যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
অর্থাৎ, হে ধনজ্ঞয়! আসক্তি ত্যাগ করে সিদ্ধি ও অসিদ্ধিতে সম বুদ্ধিযুক্ত হয়ে যোগে স্থিত থেকে কর্ম করো।
কর্ম তথা কর্মকাণ্ড পালন অবশ্যই করতে হবে(গীতাঃ৩/৮); তবে তা জ্ঞানকাণ্ডের সহিত নিষ্কাম ভাবে।
এ সম্পর্কে গীতায় আরো স্পষ্ট ভাবে বলা হচ্ছেঃ
অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ।
স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ (গীতাঃ৬/১)
অনুবাদঃ যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম ত্যাগ করেছেন এবং দৈহিক চেষ্টাশুন্য তিনি সন্ন্যাসী বা যোগী নয়। যিনি কর্মফলের আসক্তি ত্যাগ করে কর্তব্য কর্ম করেন তিনিই যথার্থ সন্যাসী বা যোগী।
আপনি যদি সত্যিই গীতা ও কৃষ্ণের ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে কি বেদ অনুসরণ করে দৈনন্দিন ক্রিয়া-কর্মাদি ও ধর্মানুষ্ঠান করবেন? নাকি কৃষ্ণের নির্দেশ অমান্য করে তথাকথিত গুরুদের নির্দেশ মতো মনগড়া নানা প্রকার নব্য সৃষ্ট বিধি বিধান পালন করবেন?
প্রশ্ন রইলো আপনার কাছে।
স্বয়ং বিচার করুন।