• সর্বশেষঃ

    বেদ পরিচয়ঃ পন্ডিত দীনবন্ধু বেদশাস্ত্রী


    বেদ আর্য্য জাতির ধম্যগ্রন্থ এবং সমগ্র মানবের আদি জ্ঞান ভাণ্ডার। জগতের যাবতীয় ধর্ম বেদ হইতেই জন্মলাভ করিয়াছে, বিশ্বের যাবতীয় ভাষা বৈদিক ভাষা হইতেই নিঃসৃত। পৃথিবীর যে কোনও মানব তাহার শিক্ষা সভ্যতা ও ভাষার ইতিহাস পাঠ করিতে ইচ্ছা করিলে তাহাকে বেদের শরণাপন্ন হইতে হয়।
    বেদের মধ্যে যে অক্ষর জ্ঞান সম্পদ স্তূপীকৃত রহিয়াছে তাহা আহরণের জন্য যুগে যুগে সব দেশের শ্রেষ্ঠ মনীষীরা আমরণ পরিশ্রম করিয়াছেন। সে পরিশ্রম এখনও শেষ হয় নাই। পৃথিবীর নানা জাতি নানা ভাষায় ও নানা ভাবে আজও বেদের গবেষণা করিতেছে। বেদের উপর পণ্ডিতগণ শ্রদ্ধা থাকিলেও সকলে বেদকে একভাবে দেখেন না। যাঁহারা বেদ-বিষয়ে গবেষণা করিয়াছেন তাঁহাদিগকে আমরা চারিভাগে ভাগ করিতে পারি। একদল বেদকে “পৌরুষেয়”, দ্বিতীয় দল “আর্ষ”, তৃতীয় দল “ঈশ্বরীয়” এবং চতুর্থ দল “অপৌরুষেয়” বলেন।


    পাশ্চাত্য পণ্ডিতেরা বেদকে পৌরুষেয়’ বলেন। তাঁহাদের মতে বেদ মানবের রচনা মনে করিয়াই তাঁহারা বেদকে পুরুষ বিশেষের রচিত বা “পৌরুষেয়” বলেন। বেদ তাঁহাদের মতে মানব মস্তিষ্কের চরম উৎকর্ষ। ঋষিদিগকেই তাঁহারা বেদ মন্ত্রের রচয়িতা ও উপদেষ্টা মনে করেন। বেদ মানব জাতির গ্রন্থ ভাণ্ডারে প্রাচীনতম গ্রন্থ ইহা তাঁহারা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেন। বেদকে কেন্দ্র করিয়াই ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। তাঁহারা এই সব সাহিত্য রাজির মধ্য হইতে প্রাচীন আর্য জাতির ইতিহাস উদ্ধার করিতে সচেষ্ট রহিয়াছেন। প্রাচীন পৃথিবীর ভৌগোলিক বৃত্তান্তও তাঁহারা বেদ হইতেই উদ্ধার করিতে প্রায়াস পাইয়াছে। পৌরুষেয়বাদী এই সব দেশী ও বিদেশী পণ্ডিত বেদকে উপাদেয় গ্রন্থ ও গবেষণার ক্ষেত্র মনে করয়িা শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখিতেছেন।


    দ্বিতীয় পক্ষ বেদকে “আর্ষ” বলেন। প্রাচীনকাল হইতেই ইহারা ঘোষণা করিয়া আসিতেছেন যে, বেদ ঋষি প্রণীত। স্বচ্ছ-হৃদয়, সত্যাচারী শুদ্ধাত্মা ঋষিরা পুণ্যবলে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ বিষয়ের যে সাক্ষাৎ জ্ঞান দর্শন করিয়াছিলেন, ইহাই বেদ মন্ত্রের সমষ্টি। ইঁহাদের মতে বেদের বিষয়ীভূত জ্ঞান সর্বদাই একরস থাকে। কল্প কল্পান্তরেও এই জ্ঞানের পরিবর্তন হয় না। এই জ্ঞান মানব জাতির উন্নতির চির সহায়। এক কথায় আর্ষবাদীরা বেদ মন্ত্রের ভাষাকে ঋষিদের নিজস্ব মনে করেন, কিন্তু বেদমন্ত্রের জ্ঞানকে ঈশ্বরের নিজস্ব মনে করেন। তাঁহাদের মতে বেদান্তর্গত ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ প্রাপ্তির নিয়ম অপৌরুষেয় বা ঈশ্বরীয়। পরমেশ্বর বেদকে উৎপন্ন করিয়াছেন এবং ইহা ঋষিদের ভাষায় প্রকাশিত হইয়াছে। পৌরুষেয় ও আর্ষ পক্ষ উভয়েরই মতেই বেদমন্ত্র একসঙ্গে রচিত হয় নাই। বেদ মন্ত্র রচনা করিতে ঋষিদের কয়েক পুরুষ অতিবাহিত হইয়াছিল। তাহার পর ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ রচিত হইয়াছে। আর্ষবাদী মতে উপনিষদ রচিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই ঋষিদের যুগ শেষ হইয়াছে। ইঁহাদের মতে বেদের মধ্যে কল্পিত উপাখ্যানও আছে। বেদের ভাষা ঋষিদের নিজের বলিয়াই তাঁহারা ইহাকে ‘আর্ষ’ বলিয়া থাকেন।


    তৃতীয় পক্ষ বেদকে “ঈশ্বরীয়” বলেন। তাঁহাদের মতে প্রত্যেক সৃষ্টির প্রথমে স্বচ্ছ হৃদয় মানবের হৃদয়ে ঈশ্বর বেদবাণীর প্রেরণা দান করেন। যে সব মানবের আত্মা পূর্ব সৃষ্টিতে শুভকর্ম দ্বারা শুদ্ধ থাকে তাঁহাদের হৃদয়ই বেদবাণীর প্রেরণা লাভ করে। ঈশ্বরীয় পক্ষ বলেন –চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, অন্তরিক্ষ ও স্বর্গলোকাদি যেমন পূর্ব কল্পের অনুযায়ী, যেমন এ কল্পে রচিত হইয়াছে তেমন পূর্ব পূর্ব কল্পে বেদ যেভাবে প্রকট হইয়াছিল এ কল্পেও সেই ভাবেই প্রকট হইয়াছে। ইহাদের মতে বেদের মন্ত্র, ভাষ্য ও অর্থ প্রত্যেক কল্পে একরূপ ভাবেই চলিয়া আসিতেছে। আর্ষপক্ষ জ্ঞানের এক রসত্ব স্বীকার করেন আর ঈশ্বরীয় পক্ষ ভাষা, শব্দ, মন্ত্র ও জ্ঞানের এক রসত্ব স্বীকার করেন। ইঁহাদের মধ্যে কেহ কেহ বলেন, - কল্পের প্রথমে ব্রহ্মার হৃদয়ে বেদ অর্পিত হইয়াছিল এবং ব্রহ্মার নিকট হইতে শিষ্য পরম্পরায় বেদ মানবের মধ্যে প্রচারিত হইয়াছে। কাহারও মতে অগ্নি, বায়ু, আদিত্য, অঙ্গিরা এই চারিজন ঋষির হৃদয়ে চারি বেদ অর্পিত হইয়াছিল। এই চারিজন ঋষি হইতেই শিষ্য পরম্পরায় বেদ মানবজাতির মধ্যে প্রচারিত হইয়াছে। ইঁহাদের মতে বেদ ‘ঈশ্বরীয়’ ও নিত্য। কল্পের প্রারম্ভে ঋষিরা ইহার প্রকাশ করিয়াছিলেন। বেদ ঋষিদের নিজস্ব বস্তু নয়, তাঁহারা বেদের রচয়িতা নহেন তাঁহারা বেদের দ্রষ্টা। উত্তর মীমাংসা বা বেদান্ত দর্শন এই ঈশ্বরীয় পক্ষ সমর্থন করিয়াছেন। উত্তর মীমাংসার মতে বেদ দিব্যবাক্।


    চতুর্থ পক্ষ বেদকে “অপৌরুষেয়” বলেন। ইঁহারা বেদের উৎপত্তি স্বীকার করেন না; অভিব্যাক্তি স্বীকার করেন। মীমাংসা দর্শনকার জৈমিনীর মতে শব্দ নিত্য। নিত্য পদার্থ অপরিণামী ও প্রবাহ ভেদে দ্বিবিধ। যাহার স্বরূপ বা গুণের কোনই পরিবর্তন হয় না তাহা ‘অপরিণামী-নিত্য’ এবং যাহা নানা রূপান্তরের মধ্যেও নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করে তাহা ‘প্রবাহ-নিত্য’। পরমাত্মা অপরিণামী-নিত্য। তিনি সর্বদাই এক রস থাকেন কিন্তু প্রকৃতি প্রবাহ-নিত্য। সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয়ের চক্র প্রকৃতি নানা পরিণাম প্রাপ্ত হয় কিন্তু কারণ রূপে ইহা নিত্য। বেদ শব্দময়। মহর্ষি জৈমিনি শব্দকে নিত্য বলিয়াছেন। অ-আ-ক-খ প্রভৃতি বর্ণের উৎপত্তি হয় না। ইহার অভিব্যক্তি হয়। স্বর্ণ হইতে অলঙ্কারের উৎপত্তি হয় কারণ অলংকার পূর্বে ছিল না। অন্ধকার গৃহে প্রদীপের সাহায্যে অলঙ্কার দৃষ্ট হয় এখানে অলঙ্কারের অস্তিত্ব পূর্বেই ছিল, তবে তাহার মাত্র অভিব্যক্তি হইল। কোনও বস্তুর অভিব্যক্তির পূর্বে তাহার উৎপত্তি হয়, উৎপত্তির পূর্বে অভিব্যক্তি হয় না। ক, খ, গ, ঘ প্রভৃতিকে অক্ষর বলে, কেননা ইহাদের ক্ষরণ বা ধংস হয় না। অক্ষর জগতের প্রত্যেক স্থানেই বর্ত্তমান রহিয়াছে। কন্ঠ, তালু, দন্ত প্রভৃতি স্থান অক্ষরকে উৎপাদন করে না, ব্যক্ত করে মাত্র। অক্ষর সমস্টি মিলিত হইয়া পদ ও শব্দসমষ্টি। ইহারা কোন অর্থ প্রকাশ করিতে মিলিত হইয়া বাক্য গঠন করে অক্ষর বা বর্ণ কোন পুরুষ বিশেষের রচিত নয় বলিয়া অপৌরুষেয়। বর্ণ অপৌরুষেয় হইলেও বিভিন্ন অর্থের সংকেত অনুসারে ইহার মিলিত হইয়া পদ গঠন করে এবং বিভিন্ন পদও অর্থের সংকেতানুসারে মিলিত হইয়া বাক্য গঠন করে। মনুষ্যকৃত গ্রন্থে এই সব বর্ণ ও বাক্যের সাহায্যে অর্থের সংকেত প্রকাশ করা হইয়াছে। বেদ ও মনুষ্যকত গ্রন্থে পার্থক্য এই স্থানে যে মনুষ্যকৃত গ্রন্থের বর্ণ বা অক্ষর অপৌরুষেয় হইলেও পদ বা বাক্য সমষ্টি পৌরুষেয়। কিন্তু বেদের পদ, শব্দার্থ, বাক্য বাক্যার্থ সবই অপৌরুষেয়। বেদমন্ত্রকে কোন পুরুষ বিশেষ রচনা করে নাই। ইহা নির্দিষ্ট আকারে অনাদিকাল হইতে চলিয়া আসিতেছে। ঋষিরা নিজের তপোবলে এই নিত্য বেদকে দর্শন করেন ও তাহাকে অভিব্যক্ত করেন। বেদমন্ত্রের অর্থকেও তাঁহারা দর্শন করেন। বেদ শব্দার্থ সন্বন্ধযুক্ত হইয়াই অনাদিরূপে অবস্থান করে। ঋষিরা যুগে যুগে ইহা প্রকাশ করেন। জৈমিনি শব্দের নিত্যতা প্রমাণ করিয়াই বেদের নিত্যত্ব সিদ্ধ করিয়াছেন এবং শব্দের অনিত্যত্ব খণ্ডন করিয়াছেন।


    শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন –‘শব্দ স্বয়ং উৎপন্ন হয় না, কণ্ঠ, তালু, দন্ত প্রভৃতির প্রযত্ন দ্বারা ইহা উৎপন্ন হয়; শব্দ এক প্রকারের উচ্চারণ ক্রিয়া। উচ্চারণের সহিত স্বল্প সময়ের জন্য শব্দ প্রত্যক্ষ হয়। ইহা প্রথমে অনুৎপন্ন ছিল, উচ্চারণের সময় স্বল্প সময়ের জন্য ইহার স্থিতি হয় এবং উচ্চারণের পরেই ইহার ধ্বংস হয়। অতএব যাহা উৎপন্ন তাহা নিত্য নহে। শব্দের নিত্যতাবাদীরা ইহার উত্তরে বলেন, উচ্চারণের পূর্বে শব্দের অস্তিত্ব আছে; ইহা নিরাকার, নিত্য ও অব্যক্তরূপে আছে। উচ্চারণ করিলে ইহা উৎপন্ন হয় না, শুধু ব্যক্ত হয় মাত্র। উচ্চারণের পর ইহার ধ্বংস হয় না শুধু শ্রবণেন্দ্রিয়র অগোচর হয় মাত্র। উচ্চারিত হইলে ইহা শ্রবণেন্দ্রিয়ের গোচরীভূত হয় এবং শব্দকারীর সহিত ইহার কোন সন্বন্ধ থাকে না। আজ একটা শব্দ শ্রুতি গোচর হইয়া জ্ঞান প্রকাশ করিল, বহুদিন পরও শব্দটী জ্ঞান প্রকাশ করিবে। ইহাতেই শব্দের নিত্যতা সিদ্ধ হয়।


    শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন-‘রাম শব্দ করিল, যদু শব্দ করিবে’ ইত্যাদি বাক্যে শব্দের কর্তা রাম ও যদুকেই বুঝায়। যখন শব্দ কোন ব্যক্তি কর্তৃক উৎপন্ন কার্য, তখন তাহার নিত্যতা হইতে পারে না’। শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘রাম ও যদু শব্দের নির্মাতা নহে, শব্দের উচ্চারণ কর্তা মাত্র। কেহই শব্দকে উৎপন্ন করিতে বলে না, উচ্চারণ করিতেই বলে। উৎপন্ন পদার্থের উপাদান কারণের প্রয়োজন হয় কিন্তু শব্দ উৎপাদনের জন্য উপাদান কারণ পাওয়া দুষ্কর। বায়ু শব্দের উপাদান কারণ নয়। বায়ু সাহায্য করে মাত্র। বায়ু শব্দকে বহন করে। ধ্বনি ও শব্দের পার্থক্য সকলেই মানিয়া থাকেন।


    শব্দের অনিত্যবাদীরা বলেন –‘এক সঙ্গে বহু লোকে মিলিয়া শব্দ করিলে তাহার বৃদ্ধি হয় এবং অল্প লোক, বালক বা রোগী উচ্চারণ করিলে তাহা হ্রাস হয়, শব্দ নিত্য হইলে তাহাতে হ্রাস বৃদ্ধি হইতে পারে না’। নিত্যতাবাদীরা বলেন- ‘বহুজনে মিলিয়া শব্দ করিলে শুধু ধ্বনি বৃদ্ধি পায়, শব্দ বৃদ্ধি পায় না। ধ্বনির হ্রাস বৃদ্ধিতে শব্দের হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে না’।


    শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘নিত্য বস্তুর হ্রাস বৃদ্ধি হয় না কিন্তু ব্যাকরণ গ্রন্থে দেখি শব্দের বিকৃতি, রূপান্তর ও হ্রাস বৃদ্ধি হয়।’ শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন-‘ব্যাকরণ গ্রন্থে যে, ‘ই’ স্থানে ‘য’ হয় বা ‘উ’ স্থানে ‘ব’ হয় ইহা আকৃতির বিকৃতি ভাব নহে এখানে দুটী বর্ণ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও পৃথক।’


    শব্দের অনিত্যতাবাদীরা বলেন –‘বহু সময় বহু স্থানে বহু লোক একই শব্দের উচ্চারণ করে। শব্দ নিত্য হইলে এইরূপ ঘটিত না।’। শব্দের নিত্যতাবাদীরা বলেন – ‘নিত্য বস্তুর ইহাও একটি লক্ষণ। একই পরমাত্মাকে বহু স্থানে বহু ব্যক্তি অনুভব করিতে পারে। ইহাতে নিত্যত্ব খণ্ডিত হয় না, সিদ্ধ হয়।’


    চারিবেদ


    পরমাত্মা যেমন নিত্য তাঁহার জ্ঞান এই বেদও নিত্য। ভিন্ন ভিন্ন বিদ্যা জানিবার জন্য একই বেদ চারিভাগে বিভক্ত হইয়াছে-ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ব্ববেদ। চারি বেদে যথাক্রমে চারি, বিষয়ের বর্ণনা রহিয়াছে, যথা- বিজ্ঞান, কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান। ঋচ্ ধাতুর অর্থ স্তুতি করা অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা; যে বেদের সর্ব পদার্থের স্তুতি অর্থাৎ গুণ প্রকাশ করা হইয়াছে তাহাই ‘ঋগ্বেদ’। যজ্ ধাতুর অর্থ দেব পুজা, সঙ্গতি করণ ও দান। যে বেদে মোক্ষ সাধনা ও ইহলৌকি ব্যবহার অর্থাৎ কর্মকাণ্ডের বিধান প্রকাশিত হইয়াছে তাহাই ‘যজুর্বেদ’। যাহাতে জ্ঞান ও আনন্দের উন্নতি হয় তাহাই ‘সামবেদ’। থর্ব অর্থে সচল এবং অথর্ব অর্থে অচল ব্রহ্ম; যাহাতে অচল ব্রহ্মের জ্ঞান ও সংশয়ের দোদুল্যমান অবস্থার সমাপ্তি হয় তাহাই ‘অথর্ব’ বেদ। ছন্দ, অথর্বাঙ্গিরস ও ব্রহ্মবেদ এগুলি অথর্ব বেদেরই নাম।


    বেদের আয়তন ও মন্ত্রসংখ্যা


    ঋগ্বেদে মোট মন্ত্র সংখ্যা ১০৫৮৯। সমস্ত ঋগ্বেদ ১০ মণ্ডলে, ৮৫ অনুবাকে ও ১০১৮ সূক্তে বিভক্ত। ঋগ্বেদকে অন্য ভাবেও বিভাগ করা হইয়াছে। যেমন-অষ্টক ৮, অধ্যায় ৬৪ ও বর্গ ১০২৪। যজুর্বেদের মোট মন্ত্র সংখ্যা ১৯৭৫ এবং সাম বেদের মন্ত্রসংখ্যা ১৮৯৩। সামবেদ ৩ ভাগে বিভক্ত, যথা পূর্বার্চিক, মহানাম্নীআর্চিক ও উত্তরার্চিক। মহানাম্নী আর্চিককে পূর্বার্চিকের মধ্যেই ধরা হয়। পূর্বার্চিক ৪ কাণ্ডে বিভক্ত, ৪ কাণ্ড ৬ প্রপাঠক বা ৫ অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রপাঠক অর্দ্ধ প্রপাঠক ও দশতিতে বিভক্ত। উত্তরার্চিক ২১ অধ্যায় ও ৯ প্রপাঠক। এই প্রপাঠকগুলিতে অর্দ্ধ প্রপাঠক আছে, দশতি নাই কিন্তু সূক্ত আছে। অথর্ব্ব বেদের মন্ত্রসংখ্যা ৫৯৭৭। অথর্ববেদে ২০ কাণ্ড। এই কাণ্ডগুলি ৩৪ প্রপাঠকে বিভক্ত। ইহাতে ১১১ অনুবাক্, ৭৭ বর্গ ও ৭৩১ সূক্ত। সমগ্র বেদে মোট মন্ত্রসংখ্যা ২০৪৩৪।


    মন্ত্রের ঋষি, দেবতা, ছন্দ


    বেদের মন্ত্রগুলি গদ্য, পদ্য ও গানে প্রকাশিত। যজুঃ গদ্যে, ঋক্ পদ্যে, এবং সাম গানে প্রকাশিত – এজন্য বেদের আর এক নাম ‘ত্রয়ী’। প্রত্যেকটি মন্ত্রের সহিত ঋষি, দেবতা, ছন্দ এবং স্বর উল্লেখিত হয়। যে যে ঋষি যে যে মন্ত্রের অর্থ প্রকাশ করিয়া মানব জাতির মহা উপকার সাধন করিয়াছেন, সেই সেই ঋষির নাম, সেই সেই মন্ত্রের সহিত স্মরণ করা হয়। ঋষিগণ মন্ত্রের রচয়িতা ছিলেন না, তাঁহারা ছিলেন মন্ত্রের দ্রষ্টা। মন্ত্রগুলিতে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়, বর্ণিত হইয়াছে। যে মন্ত্রের যেটি মুখ্য বিষয় সে মন্ত্রের সেইটিই দেবতা। মন্ত্রের বর্ণিত বিষয়কে দেবতা বলে। মন্ত্রের সহিত দেবতার উল্লেখ থাকায় দৃষ্টি মাত্রেই মন্ত্রের মূখ্য বিষয়টি উপলদ্ধি হয়। পাঠের সুবিধার জন্য মন্ত্রের সহিত ছন্দেরও উল্লেখ করা হয়। যে যে মন্ত্র, যে যে ছন্দে প্রকাশিত, সেই সেই মন্ত্রে সেই সেই ছন্দ।


    ছন্দ তিন প্রকারের – ছন্দ, অতিছন্দ ও বিছন্দ। এই তিনের প্রত্যেকটিতে ৭টি করিয়া ভেদ আছে। ছন্দ সাতটি, যথা- গায়ত্রী, উষ্ণিক্, অনুষ্টুপ্, বৃহতী, পঙ্ক্তি, ত্রিষ্টুপ ও জগতী। অতিছন্দও সাতটি। যথা – অতিজগতী, শক্করী, অতিশক্করী, অষ্টি, অত্যষ্টি, ধৃতি ও অতিধৃতি। বিছন্দও সাতটি, যথা- কৃতি, প্রকৃতি, আকৃতি, বিকৃতি, সংকৃতি, অতিকৃতি ও উৎকৃতি। এই ২১টি ছন্দের প্রত্যেকটিতে বিভিন্ন সংখ্যক অক্ষরযুক্ত থাকে। গায়ত্রীতে ২৪ অক্ষর, উষ্ণিকে ২৭টি, অনুষ্টুপে ৩২টি, বহতীতে ৩৬টি, পংক্তিতে ৪০টি, ত্রিষ্টুপে ৪৪ টি, জগতীতে ৬০টি, অত্যষ্টিতে ৬৮টি, ধৃতিতে ৭২টি, অতিধৃতিতে ৭৬টি, কৃতিতে ৮০টি, প্রকৃতিতে ৮৪টি, আকৃতিতে ৮৮টি, বিকৃতিতে ৯২টি, সংকৃতিতে ৯৬টি, অতিকৃতিতে ১০০টি এবং উৎকৃতিতে ১০৪টি অক্ষর থাকে। এই ২১ ছন্দের মধ্যে কোনটিতে এক অক্ষর কম হইলে তাহাতে নিচৃৎ এবং এক অক্ষর বেশী হইলে ভুরিজ বিশেষণ যুক্ত হয়। এই ২১ ছন্দের আর্ষী, দৈবী, আসুরী, প্রজাপত্যা, যাজুষী সাম্লী, আর্চী ও ব্রাহ্মী ভেদে ৮ ভেদ এবং বিরাট, নিচৃৎ, শুদ্ধা, ভূরিজ্ ও স্বরাট্ ভেদে ৪ ভেদ হয়। অতিছন্দ ও বিছন্দেরও ভেদ হয়। এইভাবে নানা পদ যোজনা ও অক্ষর যোজনা দ্বারা এই সব ছন্দের না না বিভেদ করা হইয়াছে।


    বেদাঙ্গ ও স্বর


    বেদাঙ্গের অভ্যাস বেদার্থ বোধের সহায়তা করে। শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এই ছয়টিকে বেদের ‘ষড়ঙ্গ’ বলে। বর্ণ, স্বর, মাত্রা, বল ও সম – ‘শিক্ষা’ এই পাঁচটি বিষয়ের শিক্ষা দান করে। স্বর ও ব্যঞ্জন ভেদে বর্ণ দুই প্রকার। অ, আ, ক, খ প্রভৃতি বর্ণগুলির জ্ঞান অত্যাবশ্যক। প্রধানত: স্বর ত্রিবিধ-উদাত্ত, অনুদাত্ত ও স্বরিৎ। উদাত্ত বিধানে উ্চ্চৈঃস্বরে, অনুদাত্ত বিধানে কোমল স্বরে, এবং স্বরিৎ বিধানে উদাত্ত ও অনুদাত্ত মধ্যবর্তী স্বরে উচ্চারণ করিতে হয়। স্বরিৎ উদাত্ত ও অনুদাত্তের মিলন স্বর ১৪ প্রকার। উদাত্ত, উদাত্ততর, অনুদাত্ত, অনুদাত্ততর, স্বরিৎস, স্বরিদুদাত্ত ও একশ্রুতি এই সতটি স্বর উদাত্ত ভেদে এবং ষডজ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ এই সাতটি স্বর যড়ঙ্গ ভেদে বিধান করা হইয়াছে। ষড়ঙ্গ বিহিত সাতটি স্বরকে সংক্ষেপে ষ-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি বলা হয়। উদাত্ত হইতে নিষাদ ও গান্ধার, অনুদাত্ত হইতে ঋষভ ও ধৈবত এবং স্বরিৎ হইতে ষডজ, মধ্যম ও পঞ্চম স্বরের উৎপত্তি পরিকল্পনা করা হইয়াছে।


    আমরা সকলেই যাহা কিছু উচ্চারণ করি উদাত্ত, অনুদাত্ত বা স্বরিৎ বিধানে উচ্চারণ করি। আয়াম অর্থাৎ অঙ্গ সকলকে রুদ্ধ করিয়া, দারুণ অর্থাৎ বাণীকে রুক্ষ করিয়া বা উচ্চেঃস্বরে এবং অণুতা অর্থাৎ কণ্ঠকে কিছু রুদ্ধ করিয়া উদাত্ত স্বরের উচ্চারণ করা হয়। ‘অন্বয়’ অর্থাৎ গাত্রকে দোলায়মান করিয়া ‘মার্দব’ অথ্যাৎ স্বরের কোমলতা করিয়া এবং উরুতা অথ্যাৎ কণ্ঠকে বিস্তৃত করিয়া অনুদাত্তের মিলনে উৎপত্তি হয়। উচ্চ, নীচ, হ্রস্ব দীর্ঘ ভেদেও স্বর উদাত্ত, উদাত্ততর, অনুদাত্ত, অনুদাত্ততর, স্বরিৎ, স্বরিতোদাত্ত ও একশ্রুতি, এই সাত প্রকারের হইয়া থোকে। স্বরিতেরও তিন ভেদ আছে –হ্রস্ব, স্বরিৎ, দীর্ঘ স্বরিৎ ও প্লুত স্বরিৎ! ষড়জ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ – এই সপ্ত স্বরকেই সংক্ষেপে ষ-ঋ-গ-ম-প-ধ-নি বলা হয়। সঙ্গীতে ও গান্ধার উদাত্তের লক্ষণে, ঋষভ ও ধৈবত অনুদাত্তের লক্ষণে ষড়জ্ মাধ্ম ও পঞ্চম স্বরিতের লক্ষণে প্রয়োগ করা হয়।


    স্বরের চিহ্ন


    বেদ মন্ত্রের উদাত্ত অনুদাত্ত ও স্বরিৎ ভেদ বুঝাইবার জন্য বৈদিক গ্রন্থ সমূহে কতগুলি চিহ্ন প্রয়োগ করা হয়। উদাত্ত স্বরের সহিত কোনও চিহ্ন প্রযুক্ত হয় না। অনুদাত্ত বর্ণের নীচে শায়িত একটি রেখা প্রযুক্ত হয়। স্বরিতের উপরে লম্বমান একটি রেখা প্রযুক্ত হয়। মাত্রা তিন প্রকারের হ্রস্ব, দীর্ঘ, প্লুত। প্লুত স্বর বুঝাইতে ৩ সংখ্যা ব্যবহৃত হয়।


    ক, খ, গ ঘ ৩ –এখানে ক উদাত্ত, খ অনুদাত্ত গ স্বরিৎ এবং ঘ প্লুত স্বরিৎ। ‘নি’ হ্রস্ব, ‘নী’ দীর্ঘ এবং নি ই ই’ প্লুত। ক্রন্দনে ও গানে প্লুত স্বর ব্যবহৃত হয়। ইহাকে দীর্ঘ করিয়া উচ্চারণ করিতে হয়। স্বরের চিহ্ন সন্বন্ধে মতদ্বৈত ও দৃষ্ট হয়। কেহ কেহ উদাত্ত বুঝাইতে বণেৃর উপরে লম্বমান রেখার, অনুদাত্ত বুঝাইতে বর্ণের নীচে শায়িত রেখার প্রয়োগ করেন এবং স্বরিতের কোনও রেখারই প্রয়োগ করেন না। কেহ কেহ স্বরিত বুঝাইতে বর্ণের নীচে একটি বক্র রেখার ও প্রয়োগ করেন। কণ্ঠ দ্বারাই স্বরের উচ্চারণ করিতে হয় কিন্তু বৈদিক পণ্ডিতেরা কেহ কেহ স্বর পাঠের সংস্কারকে দৃঢ় করিবার জন্য অঙ্গ বিশেষের পরিচালনা করেন। ঋগ্বেদ, কৃষ্ণ যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ পাঠ করিতে মস্তককে নীচু করিয়া অনুদাত্ত, উচু করিয়া স্বরিৎ, এবং মস্তককে ঠিক রাখিয়া উদাত্ত। শুক্ল যজুর্বেদ পাঠ করিতে হস্তের অগ্রভাগ সঞ্চালন করা হয়। হস্তের অগ্রভাগ নামাইয়া অনুদাত্ত, উঠাইয়া উদাত্ত এবং দক্ষিণে বামে তির্যক সঞ্চালন করিয়া স্বরিৎ প্রকাশ করা হয়। ঋক, যজু ও অথর্ববেদ সন্বন্ধেও এই ব্যবস্থা। সামবেদ ১, ২ ও ৩ সংখ্যা বর্ণের উপর প্রয়োগ করা হয়। বর্ণের উপরে ১ উদাত্ত, ২ দ্বারা অনুদাত্ত এবং ৩ দ্বারা স্বরিৎ। কেহ, ২ দ্বারা স্বরিৎ এবং ৩ দ্বারা অনুদাত্ত প্রকাশ করেন। ব্রাহ্মণ গ্রন্থের মধ্যে অন্যরূপ ব্যবস্থা অনুসৃত হয়। শুক্ল যজুর্বেদের ব্রাহ্মণের মধ্যেই স্বর উচ্চারিত হয়, চিহ্নাদিরও প্রয়োগ করা হয়। ঋক্, সাম ও অথর্ব বেদের ব্রাহ্মণের স্বর উচ্চারিত হয় না, চিহ্নাদিরও পয়োগ করা হয় না। কৃষ্ণ যজুর্বেদের ব্রাহ্মণে সংহিতার ন্যায়ই স্বরের উচ্চারণ হয় এবং চিহ্নাদির প্রয়োগ করা হয়। শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণে বর্ণের নীচে অনুদাত্তবৎ শায়িত রেখা প্রয়োগ করিয়া উদাত্ত প্রকাশ করা হয়।


    বর্ণের উচ্চারণেরে মধ্যেও নানা পার্থক্য দৃষ্ট হয়। স্বর বর্ণের মধ্যস্থিত ‘ড’ কে ‘ড়’ এবং ‘ঢ’ কে ‘ঢ়’ উচ্চারণ করা হয়। অনুদাত্তের(ং) উচ্চারণ নানাবিধ। ং স্বরকে কেহ কেহ অনুস্বারের পরে ‘ব’(উয়) সংযোগ করিয়া উচ্চারণ করেন, কেহ কেহ দীর্ঘ অনুস্বারকে ‘’ এইরূপ, হ্রস্ব অনুস্বারকে ং এইরূপ লিখিয়া থাকেন। কেহ কেহ বা বর্ণের উপর ঁ চন্দ্রবিন্দু দিয়া অনুস্বারের কার্য চালাইয়া থাকেন। দীর্ঘ অনুস্বারের উচ্চারণ গ্বু ‘’ এইভাবেই করিয়া থাকেন। ‘য’ এর উচ্চারণ কেহ কেহ ‘ইঅ’ না করিয়া ‘জ’ বৎ এবং ‘ষ’ এর উচ্চারণ ‘খ’ বৎ করিয়া থাকেন। সামবেদের উদাত্ত উচ্চারণের দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধাঙ্গুলিকে পৃথক্ রাখিয়া অন্য চারি আঙ্গুলিকে মিলিতভাবে খুলিয়া রাখা হয়। অনুদাত্ত উচ্চারণে বৃদ্ধাঙ্গুলির অগ্রভাগ তর্জনীর মধ্যপর্বে সংলগ্ন করা হয়। এবং স্বরিৎ উচ্চারণে বৃদ্ধাঙ্গুলির মধ্যে পর্বসংলগ্ন করা হয়। সামবেদে স্বরের সূক্ষ্ম তারতম্য বুঝাইতে আরও নানারূপ চিহ্ন প্রদত্ত হয়। অক্ষরের উপরে ‘র’ থাকিলে বাম হস্তের কনিষ্ঠা, অনামিকা, মধ্যমা, তর্জনী, অঙ্গুষ্ঠ এক এক করিয়া তালু দেশে মুড়িয়া আনিতে হয়। ‘উ’ অনুদাত্তের সঙ্গেই থাকে। তাহা প্রদর্শনের জন্য মধ্যম অঙ্গুলি মুড়িয়া অঙ্গুষ্ঠের মূলে আনা হয়। ‘ক’ স্বরিতেরই সঙ্গে থাকে, ইহা প্রদর্শনের জন্য অঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ দ্বারা মধ্যমার মূল ভাগ হইতে অগ্রভাগ পর্যন্ত স্পর্শ করিয়া লইতে হয়।


    উদাত্ত, অনুদাত্ত বা স্বরিতের ভেদ প্রদর্শন না করিয়া একটানা পড়িয়া যাওয়ার নামই ‘একশ্রুতি’। যজ্ঞ কর্মে একশ্রুতি স্বরে বেদ মন্ত্রের উচ্চারণ করিতে হয়। বেদ মন্ত্রের জপ করিতে ‘নূঙ্খ’ নামক বৈদিক স্তুতিতে এবং সামবেদে একশ্রুতি স্বরের ব্যবহার না করিয়া উদাত্ত, অনুদাত্ত, স্বরিতের ভেদ অনুসারে উচ্চারণ করিতে হয়।


    সামগান


    সামগানে স্বর সন্বন্ধে বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। উর, কণ্ঠ ও শির –এই তিন স্থান হইতে শব্দ উত্থিত হয়। উর স্থানকে প্রাতঃ সবন, কণ্ঠ স্থানকে মাধ্যন্দিন সবন এবং শিরস্থানকে তৃতীয় সবন মনে করিতে হইবে। এই তিন স্থানে সাত সাতটি স্বর বিচরণ করে। আমরা কর্ণ দ্বারা উহা শ্রবণ করিতে পারিনা। ৭ স্বর, ৩ গ্রাম, ২১ মূর্চ্ছনা ও ৪৯ প্রকার স্বর; ইহাকে স্বর মণ্ডল বলে। ষডজ, ঋষভ, গান্ধার, মধ্যম, পঞ্চম, ধৈবত ও নিষাদ এই ৭টি স্বর। ষডজ, মধ্যম ও গান্ধার এই তিনটি গ্রাম। ষডজ গ্রামে তান ১৪টি, মধ্যম গ্রামে ২০টি এবং গান্ধার গ্রামে তান ১৫টি। মুর্চ্চনা তিন প্রকারের – ঋষি, পিতৃ ও দেব। নন্দী, বিশালা, সুমুখী, চিত্রা, চিত্রবতী, সুখা ও বলা- এই সাতটি দেবমূর্চ্ছনা। আপ্যায়নী, বিশ্বভৃতা, চন্দা, হেমা, কপাদিনী, মৈত্রী ও বার্হতী এই সাতটি পিতৃ মূর্চ্ছনা। উত্তর মন্দ্রা, উদ্গাতা, অশ্বক্রান্তা, সৌবীরা হৃষ্যকা, উত্তরায়তা ও রজনী এই ৭টি ঋষি মূর্চ্ছনা। গানের গুণ ১০টি – রক্ত, পূর্ণ, অলঙ্কৃত, প্রসন্ন, ব্যক্ত, বিস্ক্রুষ্ট, শ্লক্ষ্ণ, সম, সুকুমার ও মধুর। সঙ্গীত শাস্ত্রানুসারে সামবেদের মন্ত্রকে গানের আকারে রাখিয়া একই মন্ত্রের বিভিন্ন শব্দকে একাধিকবার প্রয়োগ করিয়া বহুদীর্ঘ করা হয়। ইহাকে গান সংহিতা বলে। সামগানে গান সংহিতারই প্রয়োগ হয়। গান সংহিতা মন্ত্র সংহিতা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক।


    বেদপাঠ প্রণালী


    বেদমন্ত্র কোনও রূপেই বিস্মৃত না হয় এবং ইহার মধ্যে কিছুই প্রক্ষিপ্ত না হইতে পারে এ জন্য বেদ পাঠের দুই প্রণালী আছে – ‘নির্ভূজ’ সংহিতা ও ‘প্রতৃণ’ সংহিতা। মন্ত্রটি যেরূপ আছে ঠিক সেইরূপ পাঠ করিলে তাহা ‘নির্ভূজ’ সংহিতা। “অগ্নি মীডে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম” এই মন্ত্রটিকে ‘অগ্নি মীডে পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্’ ঠিক এইরূপ অবিকৃতভাবে পাঠ করিলেই তাহাকে ‘নির্ভুজ’ সংহিতা বলে। ‘প্রতৃণ’ সংহিতার বহু ভেদ আছে। যেমন পদপাঠ, ক্রমপাঠ, জটাপাঠ, ধনপাঠ ইত্যাদি। সন্ধি ও বিরাম আদি বিচার করিয়া পাঠ করিলে তাহার নাম ‘পদপাঠ’, যেমন- ‘অগ্নিম, ঈডে, পুরোহিতম, যজ্ঞস্য, দেবম্, ঋত্বিজম্’। ‘ক্রমপাঠ’ এইরূপ, যেমন –‘অগ্নিং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবম্, দেবং ঋত্বিজম্। ‘জটাপাঠ’ এইরূপ যেমন –অগ্নিং ঈডে, ঈডে অগ্নিম্। অগ্নিং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্। পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস দেবম্, দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবম্, দেবং ঋত্বিজম্, ঋত্বিজং দেবম্, দেবং ঋত্ত্বিজম্। ‘ধনপাঠ’ এইরূপ যেমন – অগ্নিং ঈডে, ঈডে অগ্নিম, অগ্নিং ঈডে পুরোহিতম্; পুরোহিতং ঈডে অগ্নিম্; অগ্নিং ঈডে পুরোহিতম্; ঈডে পুরোহিতম্, পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পূরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতং ঈডে, ঈডে পুরোহিতম্ যজ্ঞস্য, পুরোহিতং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য পুরোহিতং পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্, যজ্ঞস্য পুরোহিতম্, পুরোহিতং যজ্ঞস্য দেবম্, যজ্ঞস্য দেবম্। দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্, ঋত্বিজং দেবং যজ্ঞস্য, যজ্ঞস্য দেবং ঋত্বিজম্ ইত্যাদি।


    বেদভাষ্য ও ভাষ্যকার


    বেদের তত্ব ও রহস্যকে সুস্পষ্ট করিতেই বিভিন্ন ভাষ্যের সৃষ্টি হইয়াছে। স্মরণাতীত কাল হইতে কত জনে, কতভাবে বেদভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছেন। ভাষ্যকারদের মধ্যে প্রাচীন কালের সায়ণাচার্য এবং বর্তমান যুগের দয়ানন্দ সরস্বতীই উচ্চস্থান অধিকার করিয়াছেন। সায়ণাচার্যের ঋগ্বেদ ভাষ্য পড়িলে জানা যায়, তিনি সংস্কৃত সাহিত্যে এক ধুরন্ধর পণ্ডিত ছিলেন। সায়ণাচার্য্য চতুর্দশ শতাব্দীতে বিজয় নগরের মহারাজার মন্ত্রীপদে অসীন ছিলেন। তাঁহার ভাষ্য পড়িলে মনে হয়, তিনি একাকী সমগ্র ভাষ্য প্রণয়ন করেন নাই। তাঁহার নেতৃত্বে অন্যান্য পণ্ডিতেরা ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছিলেন। মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী(১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ) বর্তমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বেদজ্ঞ পণ্ডিত। পণ্ডিত রোম্যাঁরলার মতে –“আচার্য শঙ্করের পর বেদের এতবড় পণ্ডিত ভারতে জন্ম গ্রহণ করেন নাই”।


    ঋগ্বের ভাষ্যকার


    ১। স্কন্দস্বামী(৬৩০খৃঃ)। ২। নারায়ণ (৬৩০খৃঃ)। ৩। উগ্দীথ(৬৩০খৃঃ)। ৪। হস্তামলক(৭০০খৃঃ)। ৫। বেঙ্কট মাধব (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ)। ৬। লক্ষণ (খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমভাগ)। ৭। ধানুকযজ্বা (খ্রীষ্টীয় ১৩শ শতাব্দী)। ৮। আনন্দতীর্থ (১১৯৮-১২৭৮ খৃঃ)। ৯। আত্মানন্দ (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ১০। সায়ণাচার্য (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী) । ১১। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ১২। মুদ্গল (১৫শ শতাব্দী)। ১৩। চতুর্বেদ স্বামী (১৬শ শতাব্দী)। ১৪। দেবস্বামী ভট্টভাস্কর উবট (১১শ শতাব্দী)। ১৫। হরদত্ত। ১৬। সুদর্শন সুরি। ১৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১৮৮৩খৃঃ)।


    যজুর্বেদ ভাষ্যকার


    ১। শৌনক। ২। হরিস্বামী (৫৮১খৃঃ)। ৩। উবট (১১শ শতাব্দী)। ৪। গৌরধর (১২৯৩ খৃঃ)। ৫। রাবণ (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ৬। মহীধর (খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)। ৭। দয়ানন্দ সরস্বতী (১৮২৫-১১৮৩ খৃষ্টাব্দ)


    সামবেদ ভাষ্যকার


    ১। গুণ বিষ্ণু (খৃঃ ১৩শ শতাব্দী)। ২। মাধব। ৩। ভরত স্বামী (খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। ৪। সায়ণাচার্য(খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। ৫। শোভাকর ভট্ট (খৃঃ ১৫শ শতাব্দী)। ৬। মহাস্বামী। ৭। সূর্যদৈবজ্ঞ(খৃঃ ১৬শ শতাব্দী)।


    অথর্বদেব ভাষ্যকার


    ১। সায়নাচার্য(খৃঃ ১৪শ শতাব্দী)। দয়ানন্দের পরে পণ্ডিত জয়দেব বিদ্যালংকার আজমীড় হইতে চতুর্বেদের ভাষ্য প্রণয়ন করিয়াছেন। মহামহোপাধ্যায় আর্যমুনি এবং পণ্ডিত শিবশংকর কাব্যতীর্থের বেদভাষ্য উচ্চ সম্মান লাভ করিয়াছে। পণ্ডিত সত্যব্রত সামশ্রমীর যজুর্বেদ ভাষ্য, তুলসীরাম স্বামীর সামবেদ ভাষ্য এবং পণ্ডিত ক্ষেমকরণের অথর্ববেদ ভাষ্য বর্তমানে আদৃত হইয়াছে।


    বেদের অঙ্গ, উপাঙ্গ, উপবেদ


    বেদার্থ জানিবার জন্য শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, ছন্দ ও জ্যোতিষ এই ‘ষড়ঙ্গ’ প্রবর্তিত হইয়াছে। ‘শিক্ষা’ ছয় প্রকারের –শব্দ, শব্দাঘাত, শব্দাবয়ব, শব্দাবয়বাঘাত, স্বর মাধুর্য ও শব্দ সন্ধি। শিক্ষা গ্রন্থে এই সকল শিক্ষা দেওয়া হয়। শ্রৌত, গৃহ্য, ধর্ম ও শল্ব এই চারি সূত্রের নাম ‘কল্প’। ইহাতে যজ্ঞ প্রয়োগ বিধি কল্পিত হইয়াছে বলিয়া ইহার নাম কল্প। আপস্তন্ব, বৌধায়ন, আশ্বলায়ন, প্রভৃতি ঋষিরা সূত্রাকারে কল্প গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছেন। শ্রোত সূত্রে ধর্মানুষ্ঠান ও যজ্ঞ সন্বন্ধের বিধান; গৃহ্য সূত্রে গার্হস্থ্য বিধি, গর্ভাধান হইতে অন্ত্যেষ্টি এই ষোড়শ সংস্কার ও পঞ্চ মহাযজ্ঞের বিধান, ধর্মসূত্রে দায়ভাগ, শাসন বিধি কর্মবিধি ও চারিবর্ণের আচার বিচার এবং শূল্ব সূত্রে বেদীরচনা, অগ্নি কুণ্ড রচনাদি বর্ণিত আছে। শূল্ব সূত্রের সন্বন্ধ শ্রৌত্র সূত্রেরই সঙ্গে।


    কর্ম কাণ্ডের জন্য সূত্র গ্রন্থ রচিত হইয়াছে। ঋগ্বেদের আশ্বলায়ন ও সাংখ্যায়ন শ্রৌত সূত্র এবং ইহাদের উভয়ের গৃহ্য সূত্রও পাওয়া যায়। শৌনকের এক প্রতিশাখ্য সূত্র আছে। যজুর্বেদের কঠ, মানব, লৌগাক্ষি, কাত্যায়ন, ভারদ্বাজ, আপস্তন্ব, হিরণ্যকেশী বাধুল, বৈখানস, মৈত্রা বরুণী ও ছাগল শ্রৌতসূত্র পাওয়া যায়। গৃহ্যসূত্র ও এতগলিই আছে। শুক্ল যজুর্বেদের কাত্যায়ন ও বৈজপায় শ্রোতসূত্র, পারস্কর ও কাতীয় গৃহ্যসূত্র। কাত্যায়নের এক প্রতি শাখায় আছে। সামবেদের পঞ্চবিংশ ব্রাহ্মণের এক শ্রৌতসূত্র ও এক গৃহ্যসূত্র আছে। দ্বিতীয় –লাট্যায়ন শ্রোতসূত্র বা মশকসূত্র, তৃতীয় –দ্রাক্ষায়ণ শ্রৌত্রসূত্র, চতুর্থ – অনুপদ সূত্র, পঞ্চম-গোভিল কৃত পুষ্প সূত্র এবং তাণ্ডা, লক্ষণ, উপগ্রন্থ, কল্পানুপদ, অনুস্তোত্র ও ক্ষুদ্র সূত্র আছে। ইহার গৃহ্য সূত্রের মধ্যে গোভিল গৃহ্যসূত্র; কাত্যায়ন কর্মদীপ, খদির গৃহ্যসূত্র ও পিতৃমেধসূত্র আছে। অর্থববেদের কৌশিক, বৈতান, নক্ষত্র কল্প, অঙ্গিরস ও শান্তিকল্প সূত্র আছে।


    যাহা দ্বারা ভাষায় সম্যক জ্ঞান লাভ হয় তাহার নাম ‘ব্যাকরণ’। পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী ব্যাকরণই বর্তমানে একমাত্র বৈদিক ব্যাকরণ। মহর্ষি পতঞ্জলি ইহার উপর মাহভাষ্য নামে এক ভাষ্য রচনা করিয়াছিলেন। পাণিনির পূর্বেও বহু বৈদিক বৈয়াকরণ বিদ্যমান ছিলেন, তন্মধ্যে সাকল্য, সেনাকাশ, স্ফোটায়ন, গার্গ্যেয়, গালব, শত্রুবর্মন্, ভারদ্বাজ, অপিশালী ও কাশ্যপের নাম উল্লেখযোগ্য। ইহাদের ব্যাকরণ হইতেই পাণিনি সুত্রাকারে অষ্টাধ্যায়ী প্রণয়ন করিয়াছিলেন।


    নিরক্ত গ্রন্থে বৈদিক শব্দ ও বাক্য সমূহের অর্থ সুস্পষ্ট করা হইয়াছে। যাস্কমুনি কৃত অতি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ নিরুক্ত গ্রন্থই বর্তমানে আদৃত হইতেছে। যাস্কের পূর্বেও কৌৎস, শাকপুণি ঔর্ণনাভ ও স্থোলাষ্টীরী প্রভৃতি নিরুক্তকার বিদ্যমান ছিলেন। যাস্ক খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর লোক। নিঘন্টু নিরুক্তের অঙ্গীভূত। নিঘন্টু বেদের অর্থ প্রকাশক শব্দকোষ বা অভিধান মাত্র। দেবরাজ যজ্বা নিঘন্টুর টীকা লিখিয়াছেন এবং দুর্গাচার্য নিরুক্তের বৃত্তি প্রণয়ন করিয়াছেন। ছন্দ সন্বন্ধে পূর্বেই বর্ণনা করা হইয়াছে। ‘জ্যোতিষ’ গ্রন্থে আকাশস্থ জ্যোতিষ্ক মণ্ডলীর গতি বিধি সন্বন্ধে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। ‘উপাঙ্গ’ ছয়টি। গৌতমের ন্যায়, কণাদের বৈশেষিক, কপিলের সাংখ্য, পতজ্ঞলির যোগ, জৈমিনির পূর্ব মীমাংসা এবং ব্যাসদেবের ব্রহ্মসূত্র বা উত্তর মীমাংসা (বেদান্ত)। উপাঙ্গের তীক্ষ্ ন বিচার দ্বারা বেদের সিদ্ধান্ত প্রমাণিত হইয়াছে। ‘উপবেদ’ চারি প্রকারের। ধনুর্বেদ বা যুদ্ধবিদ্যা, গন্ধর্ববেদ বা সঙ্গীত বিদ্যা, অর্থবেদ বা শিল্প বিদ্যা, আর্য়ুবেদ বা চিকিৎসা বিদ্যা।


    বেদের ছয় উপাঙ্গের নাম ষড়দর্শন বা ষট্ শাস্ত্র। জৈমিনি কৃত পূর্ব মীমাংসা সূত্রে কর্মকাণ্ডের বিধান ধর্ম ও ধর্মী সন্বন্ধে বর্ণনা রহিয়াছে। ব্যাসদেব পূর্ব মীমাংসার ভাষ্য রচনা করিয়াছেন। গৌতমমুনি কণাদ কৃত বৈশেষিক সূত্রের প্রশস্ত পাদ ভাষ্য, বাৎসায়ন মুনি গৌতম কৃত ন্যায় সূত্রের ভাষ্য, ব্যাসদেব পতঞ্জলি কৃত।