• সর্বশেষঃ

    মনীষী বচনে বেদের মহত্ব


    মানুষের মধ্যে যেমন কর্মগুণে ব্রাহ্মণ, ঔষধির মধ্যে অমৃত, নদীর মধ্যে গঙ্গা, পশুর মধ্যে গরু যেমন সর্বশ্রেষ্ঠ তেমনি সমস্ত গ্ৰন্থের মধ্যে বেদ সর্বশ্রেষ্ঠ।

    বেদ শব্দটি "বিদ্" ধাতু থেকে নিষ্পন্ন। "বিদ্" ধাতুর অর্থ - জানা।সেইজন্য বেদ শব্দের ধাতুগত অর্থ - জ্ঞান বা বিদ্যা দুই প্রকার পরা এবং অপরা। অলৌকিক জ্ঞান - পরাবিদ্যা। জাগতিক বিষয় সম্বন্ধীয় যাবতীয় লৌকিক জ্ঞান - অপরা বিদ্যা। পরা ও অপরা এই দুই বিদ্যাই স্থান পেয়েছে সেই জন্য বেদকে সর্ব জ্ঞানের ভান্ডার বলা হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বেদের বেদত্ব ওই পরাবিদ্যা বা ব্রহ্মবিদ্যা প্রকাশের জন্য।পরাবিদ্যাই শ্রেষ্ঠ বিদ্যা । 

                   "বিদ্‌" ধাতুর চারিপ্রকার অর্থ হয় ➼
                              বেত্তি বেদ বিদ্‌ জ্ঞানে,
                               বিন্তে বিদ্‌ বিচারণে।
                               বিদ্যতে বিদ্‌ সত্তায়াং,
                               লাভে বিদন্তি বিন্দতে।।

    এই চারিপ্রকার অর্থ হইতেছে - জানা, বিচার করা, অবস্থান করা ও লাভ করা। যাহা পাঠ করলে মানুষ সত্য জানিতে পারে, সত্য এবং অসত্যের বিচার করিতে পারে, প্রকৃত বিদ্বান হইতে পারে, প্রকৃত শান্তি এবং আনন্দ লাভ করিতে পারে, তাহার নাম বেদ। বেদ শব্দের দুই অর্থ - মুখ্য ও গৌণ। ইহার মুখ্য অর্থ হল জ্ঞান রাশি, আর গৌণ অর্থ হল শব্দরাশি। বৈদিক জ্ঞান রাশি আত্মপ্রকাশ করে বৈদিক শব্দরাশির সাহায্যে।
    বেদ ঈশ্বরীয় জ্ঞান যা সৃষ্টির প্রারম্ভে মানবের কল্যাণের জন্য দেওয়া  হয়েছে।বেদ হলো বৈদিক সংস্কৃতির মূলাধার। এই সংসার রুপ সাগর পারের জন্য বেদ হলো নৌকারুপ।বেদে মনুষ্য জীবনের সমস্ত সমস্যার সমাধান আছে।অজ্ঞানান্ধাকারে পতিত মানুষের জন্য বেদ প্রকাশস্তম্ভ। ভুল পথে গমনকারী লোকের জন্য বেদ সত্য মার্গ দেখায়। পথভ্রষ্টকে কর্তব্য জ্ঞান প্রদান করে। আধ্যাত্ম পথের পথিক এর জন্য প্রভু প্রাপ্তির সাধনার উপদেশ দেয়। সংক্ষেপে বেদ অমূল্য রত্ন ভান্ডার।
    বেদ মানবজাতির সর্বস্ব।

    মহর্ষি অত্রি বলেছেন➨
    “নাস্তি বেদাত্ পরং শাস্ত্রম্।”(অত্রিস্মৃতি ১৫১)
    অর্থাৎ বেদের চেয়ে বড়ো কোনো শাস্ত্র নেই।

    মহর্ষি মনু লিখেছেন➨
    “য়োনধীত্য দ্বিজো বেদমন্যত্র কুরুতে শ্রমম্।
    স জীবনত্রেব শুদ্রত্বমাশু গচ্ছতি সান্বয়ঃ।।”(মনুসংহিতা ২/১৬৮)
    অর্থাৎ যে দ্বিজ(ব্রহ্মচারী/ব্রাহ্মণ) বেদ না পড়ে অন্যান্য শাস্ত্র পড়ে পরিশ্রম করে,সে জীবনাবস্থাতেই নিজের কুলসহিত শুদ্রে পরিনত হয়।

    বেদের মহত্ব মহর্ষি মনু,মনুসংহিতাতে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করেছেন➨
    “সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ।।”(মনুসংহিতা ২/৭)
    অর্থাৎ বেদ সকল জ্ঞানের ভান্ডার।

    তিনি এটাও লিখেছেন যে➨
     “কোনো ব্রাহ্মণ যদি তপস্যা করতে চায় তাহলে সেই ব্রাহ্মণ যেন বেদ অভ্যাস করে,বেদ অভ্যাসই হলো ব্রাহ্মণের পরম তপস্যা।”(মনুসংহিতা ৬/৩৭)

    মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন➨
    “যজ্ঞানাং তপসাঞ্চৈব শুভানাং চৈব কর্মণাম্।
    বেদ এব দ্বিজাতীনাং নিঃশ্রেয়সকরঃ পরঃ।।”(যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি ১/৪০)
    অর্থাৎ যজ্ঞের বিষয়ে,তপস্যার বিষয়ে,শুভ কর্মের জ্ঞানার্থ দ্বিজের জন্য বেদ পরম কল্যাণের সাধন।

    অত্রি স্মৃতি শ্লোক ৩৫১➨
    “শ্রুতিঃ স্মৃতিশ্চ বিপ্রাণাং নয়নে দ্বে প্রকীর্তীতে।
    কাণঃ স্যাদেকহীনোপি দ্বাভ্যামন্ধঃ প্রকীর্তীতঃ।।”
    অর্থাৎ শ্রুতি=বেদ এবং স্মৃতি- এই দুটিকে ব্রাহ্মণের চোখ বলা হয়েছে। যদি এই দুটির মধ্যে যে কোনো একটি না থাকে তবে সেই ব্রাহ্মণ কাণা বলে বিবেচিত হবে এবং দুটোই যদি না থাকে তবে সে অন্ধ বলে বিবেচিত হবে।

    বৃহস্পতি স্মৃতিতে ৭৯তে বেদের প্রশংসা করা হয়েছে,যা নিম্নরূপ➨
    “অধীত্য সর্ববেদান্বৈ সদ্দো দুঃখাত প্রমুচ্যতে।
    পাবনং চরতে ধর্ম স্বর্গলোকে মহীয়তে‌।”
    অর্থাৎ বেদের অধ্যায়ন করে মানুষ শীঘ্রই দুঃখ থেকে মুক্তি পায়,সে পবিত্র ধর্মের আচরন করে এবং স্বর্গলোকের মহিমা প্রাপ্ত হয়।

    প্রাচীন সমস্ত স্মৃতিকার, দর্শন শাস্ত্রকার, উপনিষদকার তথা রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতির লেখকেরা এমনকি এমনকি পুরানকার রাও বেদকে ঈশ্বরীয় তথা স্বতঃ প্রমাণ  এবং অন্য সমস্ত গ্রন্থকে পরতঃ প্রমাণ বলেছেন। 

    উদাহরণস্বরূপ মনু বলেছেন➨
    “বেদোখিলো ধর্মমূলম্।”(মনুসংহিতা ২/৬)
    অর্থাৎ বেদ হল হল ধর্মের মূল। ধর্মের বিষয়ে বেদ স্বতঃ প্রমাণ।

    মনুসংহিতা ২/১৩ এ লেখা আছে➨
    “ধর্ম জিজ্ঞাসমানানাং, প্রমাণং পরমং শ্রুতিঃ।।”
    অর্থাৎ যে ধর্মের জ্ঞান প্রাপ্ত করতে চায় তাঁর জন্য পরম প্রমাণ বেদ।

    এছাড়াও বলেছেন➨
    “পিতৃদেবমনুষ্যাণাং বেদশ্বক্ষুঃ সনাতনম্। অশক্যং চাপ্রমেয়ং চ, বেদশাস্ত্রং ইতি স্থিতিঃ।।”(মনুসংহিতা ১২/৯৪)
    “চাতুর্বণ্যং ত্রয়ো লোকা শ্চত্বারশ্চাশ্রমাঃ পৃথক্। ভূতং ভব্যং ভবিষ্যং চ, সর্বং বেদাত্প্রসিধ্যতি।।”(মনুসংহিতা ১২/৯৭)
    “বিভর্তি সর্বভূতানি,বেদশাস্ত্রং সনাতনম্।তস্মাদেতত্পরং মন্যে যজ্জন্তোরস্য সাধনম।।”(মনুসংহিতা ১২/৯৯)

    সারাংশ এটাই যে, বেদ পিতৃ, দেব, মনুষ্য সকলের জন্য সনাতন মার্গদর্শক চোখের সমান। বেদের মহিমা পূর্ণভাবে প্রতিপাদন করা খুবই কঠিন। চার বর্ণ, তিন লোক, চার আশ্রম, ভূত, ভবিষ্যৎ এবং বর্তমান বিষয়ক জ্ঞান বেদ থেকেই প্রসিদ্ধ হয়। সনাতন (নিত্য) বেদ শাস্ত্র সকল প্রাণীকে ধারণ করে এটাই সকল মানুষের জন্য ভবসাগর পারের সাধন।
    ব্রাহ্মণ গ্রন্থ এবং ঊপনিষদেও বেদ কে ঈশ্বরীয় জ্ঞান মানার স্পষ্ট প্রতিপাদন রয়েছে।

    শতপথ ব্রাহ্মণ তথা তদন্তর্গত বৃহদারণ্যক উপনিষদে স্পষ্ট বলা হয়েছে➨
    “এতস্য বা মহতো ভূতস্য নিশ্বসিতমেতত্।
    য়ত্ ঋগ্বেদো যজুর্বেদঃ সামবেদোথর্ববেদঃ।।”(বৃহদারণ্যক উপনিষদ ৪/৫/১১)
    অর্থাৎ ঋকবেদ যজুর্বেদ সামবেদ এবং অথর্ববেদ সেই মহান পরমেশ্বরের নিঃশ্বাস স্বরূপ।

    শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে➨
    “স (প্রজাপতিঃ) শ্রান্তস্তেপানো ব্রহ্মৈব প্রথমমসৃজত ত্রয়ীমেব বিদ্দ্যাম্।।”
    অর্থাৎ প্রজাপতি পরমেশ্বর নিজের তপস্যা বা পূর্ব জ্ঞান দ্বারা বেদের নির্মাণ করেছেন যা ওই ত্রয়ীবিদ্যা নামে পরিচিত কেননা তাতে জ্ঞান কর্ম এবং উপাসনার প্রতিপাদন রয়েছে।

    মুন্ডক উপনিষদে বেদ কে ঈশ্বরীয় জ্ঞান মানার স্পষ্ট প্রতিপাদন রয়েছে➨
    “অগ্নির্মুর্ধা চক্ষুষী চন্দ্রসূর্যো দিশঃ শ্রোত্রে বাগ্বিবৃতাশ্চ বেদাঃ।।”(মুন্ডক উপনিষদ ২/১/৪)
    অর্থাৎ সেই ঈশ্বরের মস্তক অগ্নি'র সমান, সূর্য এবং চন্দ্র যার চোখের সমান, দিক যার কানের তুল‍্য, বেদ যার বানী অর্থাৎ ঈশ্বরীয়।

    তণ্ড‍্যয় ব্রাহ্মণ তথা তদন্তর্গত ছান্দোগ্য উপনিষদে ছন্দের দ্বারা বেদের মহিমা উপস্থাপন করা হয়েছে➨
    “দেবা বৈ মৃত্যোর্বিভ্যতস্ত্রয়ীং বিদ্যাং প্রাবিশন্ তে ছন্দোভিরচ্ছাদয়ন,য়দেভিরচ্ছাদয়ন,তচ্ছান্দসাং ছন্দস্ত্বম্।”(ছান্দোগ্য উপনিষদ ১/৪/২)
    অর্থাৎ দেবতারা (সত্যনিষ্ঠ বিদ্বানেরা) মৃত্যুর দ্বারা ভয়ে ভীত হয়ে ত্রয়ীবিদ্যা (জ্ঞান,কর্ম, উপাসনার প্রতিপাদনকারী বেদ) এর আশ্রয় নেয়। তাঁরা বেদ মন্ত্র দ্বারা নিজেদেরকে আচ্ছাদিত করে নেয় এবং এইজন্য ইহাকে ছন্দও বলা হয়।

    মহাভারতে বেদের মহত্ব➨
    মহাভারতে মহর্ষি বেদব্যাস বেদ কে নিত্য এবং ঈশ্বর কৃত বলেছেন এবং বেদ কে অর্থ শহিত অধ্যয়ন করার জন্যও বলেছেন।
    “অনাদিনিধনা নিত্যা বাগূত্সৃষ্টা স্বয়ম্ভূবা।
    আদৌ বেদময়ী দিব্যা য়তঃ সর্বাঃ প্রবৃত্তয়ঃ।।”
                                (মহাভারত শান্তি পর্ব ১২/২৩২/২৪)
    অর্থাৎ সৃষ্টির আদিতে স্বয়ম্ভূ পরমাত্মা এই বেদ বাণী প্রকাশিত হয়েছিল যার না আদি আছে,না অন্ত,যা নিত্যনাশরহিত এবং দিব্য।যা থেকে জগতের সমস্ত প্রবৃত্তির প্রকাশ পেয়েছে।

    এই অধ্যায়ে আরো বলা হয়েছে ➨
    “নানারুপং চ ভূতানাং, কর্মণাং চ প্রবর্তনম্।
    বেদশব্দেভ্য এবাদৌ,নির্মিতীনে স ঈশ্বরঃ।।
    নামধেয়ানি চর্ষীণাং,য়াশ্চ বেদেষু দৃষ্টয়ঃ।
    শর্বর্য়ন্তে সুজাতানাং,তান্যেবৈভ্যো দদাত্যজঃ।।”(মহাভারত শান্তিপর্ব মোক্ষ ধর্মপর্ব ২৩২/২৫/২৭)
    অর্থাৎ ঈশ্বর বস্তুর নাম এবং কর্ম বেদের শব্দের দ্বারা নির্মাণ করেছেন।ঋষিদের নাম এবং জ্ঞান প্রলয়ের শেষে অর্থাৎ সৃষ্টির প্রারম্ভে বেদের দ্বারা করছেন। বেদের অর্থ সহিত অধ্যায়নের উপর জোর দিয়ে, 
    মহর্ষি ব্যাসদেব বলেছেন➨
    “য়ো বেদে চ শাস্ত্রে চ, গ্ৰন্থধারণতত্পরঃ।
     ন চ গ্ৰন্থার্য়তত্বজ্ঞঃ,তস্য তদ্ধারণং বৃথা।।
    ভারং স বহতে তস্য গ্ৰন্থস্যার্থ ন বেত্তি য়ঃ।
    য়স্তু গ্ৰন্থার্থতত্ত্বজ্ঞো নাস্য গ্ৰন্থাগমো বৃথা।।”
    (মহাভারত শান্তি পর্ব মোক্ষ ধর্মপর্ব ৩০৫/১৩/১৪)
    অর্থাৎ যে কেবল বেদ পড়ে কিন্তু বেদের অর্থ এবং তত্ত্ব জানেনা, তাঁর এই প্রকার অধ্যায়ণ নিষ্ফল হয়ে যায়। অতএব সকলের উচিত বেদের অধ্যায়ণ অর্থ এবং তত্ত্বের সাথে করা।

    ➽দর্শন শাস্ত্রে বেদের মহত্ব➧
    ন্যায়, বৈশেষিক,সাংখ্য,যোগ, মীমাংসা এবং বেদান্ত এই ছয় দর্শন শাস্ত্র যা গৌতম,কণাদ,কপিল, পতঞ্জলি,জৈমিনি এবং ব্যাসদেব রচিত। এই সমস্ত দর্শন শাস্ত্রে বেদের মহত্বের স্পষ্টততা স্বীকার করা হয়েছে।
    উদাহরণস্বরূপ,
     ন্যায় দর্শনে➣
    “মন্ত্রায়ুর্বেদ প্রামাণ্যবচ্চ তত্প্রমাণ্যমাপ্তপ্রামাণ্যাত্।”(২/১/৬৭)
     সুত্রে পরম আপ্ত পরমেশ্বরের বাণী এবং অসত্য, পরস্পর বিরোধী এবং পুনরোক্তি দোষরহিত হওয়ায় বেদকে পরম প্রমাণ হিসেবে সিদ্ধ করা হয়েছে।

    বৈশেষিক শাস্ত্রকার কণাদ মুনি➣
    “তদ্ বচনাদাম্নায়স্য প্রামাণ্যম্।”(১০/১/৩)
    এই সূত্রের দ্বারা পরমেশ্বরের বাণী হওয়ায় আম্নায় অর্থাৎ বেদকে প্রামাণ্য বলা হয়েছে।  
    আর একটি সূত্রে বলা হয়েছে-
    “বুদ্ধিপূর্বা বাক্যকৃতির্বেদ।”(৬/১/১)
    অর্থাৎ বেদ বাক্য রচনা বুদ্ধিপূর্বক। এখানে সৃষ্টিক্রম বিরুদ্ধ কোনো কথা নেই।অতএব ইহা ঈশ্বরীয় জ্ঞান।

    সাংখ্য দর্শনে কপিল মুনি ➣
    “শ্রুতি বিরোধাত্র কুতর্কাপসদস্যাত্মলাভঃ।”(৬/৩৪)
    শ্রুতি বিরুদ্ধ কুতর্ককারীরা কখনোই আত্মজ্ঞান প্রাপ্ত হন না। এই সূত্রের মাধ্যমে সাংখ্যকার বেদের প্রামাণিকতা স্বীকার করেছেন।
    এছাড়াও একটি সূত্রে বলা হয়েছে-
    “ন পৌরুষেয়ত্বং তত্কর্তুঃ পুরুষস্যাভাবাত্।”(৫/৪৬)
    অর্থাৎ-বেদ পৌরুষের নয়,কেনন বেদের রচয়িতা কোনো পুরুষ নয়।জীব অল্পজ্ঞ এবং অল্পশক্তি হওয়ায় সে সমস্ত বিদ্যার ভাণ্ডার বেদ রচনা করতে অসমর্থ।বেদ মনুষ্য রচনা না হওয়ায় বেদ অপৌরুষেয়।
    আর একটি সূত্রে বলা হয়েছে➙
     “নিজশক্ত‍্যভিব্যক্তেঃ স্বতঃ প্রমাণ্যংম্।”(৫/৫১) 
    সূত্রের দ্বারা বেদকে ঈশ্বরীয় শক্তি থেকে অভিব্যক্ত(প্রকট) হওয়ায় স্বতঃ প্রমাণ মানা হয়েছে।

    যোগদর্শনকার পতঞ্জলি মুনি➣
    যোগদর্শনে এক জায়গায় বলা হয়েছে➞
    “তত্র নিরতিশয়ং সর্বজ্ঞ বীজম্”(যোগ ১/২৫)
     সেই (ঈশ্বর)এর সর্বজ্ঞ হওয়া এতটাই নিমিত্ত যে তিনি ছাড়া আর কারোরই সেই ক্ষমতা নাই।
    “স এষ পূর্বেমেষামপি গুরুঃ কালেনানবচ্ছেদাত্।”(যোগ ১/২৬)
    ঈশ্বরকে এইভাবে সমস্ত জ্ঞানের স্তোত্র মেনে বলেছেন সেই(ঈশ্বর)যার কাল বিভাগ নেই, তিনি পূর্ব ঋষিদের ও গুরু।
    অর্থাৎ তিনি জগতের প্রারম্ভে বেদরুপী জ্ঞান দিয়ে মানুষকে শিক্ষিত করেছেন। এই দর্শন এটাই সিদ্ধ করে যে,বেদ হলো ঈশ্বরীয় জ্ঞান। বেদজ্ঞান দান করায় পরমেশ্বর কে আদি গুরু মানা হয়েছে।

    বেদান্ত শাস্ত্রের কর্তা ব্যাসদেব➣
    “শাস্ত্র য়োনিত্বাত্” (১/১/৩) তে তথা “অতএব চ নিত্যত্বম্”(১/৩/২৯) ইত্যাদি সূত্রের দ্বারা পরমেশ্বরকে ঋগ্বেদাদি রুপ সর্ব জ্ঞানের কর্তা মেনে বেদের নিত্যতা প্রতিপাদন করা হয়েছে।
    “শাস্ত্রয়োনিত্বাত্”(১/১/৩)
    এই সূত্রের ভাষ্যে শঙ্করাচার্য যা লিখেছেন তাও এই প্রসঙ্গে মহত্বপূর্ণ হওয়ার কারণ উল্লেখনীয়। তিনি লিখেছেন➟
    “ঋগ্বেদাদেঃ শাস্ত্রস্যানেকবিদ্যা স্থানোপ্বৃংহিতস্য প্রদীপবত্ সর্বার্থাবধোতিনঃ সর্বজ্ঞকল্পস্য য়োনিঃ কারণং ব্রহ্ম। নহীদৃশস্য-র্গ্বেদাদি লক্ষণস্য সর্বজ্ঞগুণাচিতস্য সর্বজ্ঞাদন্যতঃ সংভবোস্তি।”
    অর্থাৎ ঋগ্বেদাদি যে চার বেদ আছে যা অনেক বিদ্যার দ্বারা যুক্ত, সূর্যের সমান সমস্ত সত্য অর্থের প্রকাশ করে,যা সর্বজ্ঞত্বাদী গুণযুক্ত পরমেশ্বরের বাণী, কেননা সর্বজ্ঞ ব্রহ্ম ছাড়া কোনো জীব সর্বজ্ঞ গুণযুক্ত এই বেদকে তৈরি করতে পারে না।

    মীমাংসা শাস্ত্রের কর্তা জৈমিনি ধর্মের লক্ষণ সম্পর্কে বলছেন➣
     “চোদনালক্ষণোর্থো ধর্মঃ” অর্থাৎ বেদের আজ্ঞাই হল ধর্ম, এবং যা বেদবিরুদ্ধ তা অধর্ম। এই ভাবে সমস্ত শাস্ত্র একস্বরে বেদের নিত্যতা এবং স্বতঃ প্রমাণতা প্রতিপাদন করে।
    সনাতন ধর্মের মানুষেরা ছাড়াও অন্যান্য মত-সম্প্রদায়ের অনেকেই বেদের মহত্বের আলোচনা করেছেন।

    ➽বেদ সম্পর্কে গৌতম বুদ্ধ এর কিছু কথা➧
    বেদ এবং বেদজ্ঞকে উনি প্রশংসা করেছেন/ উদাহরণস্বরূপ সুত্তনিপাত ২৯২তে বলেছেন➨
    বিছা চ বেদেহি সমেচ্চধম্মং।
    ন উচ্চাবচং গচ্ছতি ভুরিপঞ‍্যো।।
    যার সংস্কৃত অনুবাদ-
    বিদ্বাংশ্চ বেদৈঃ সমেত্য ধর্ম,
    নোচ্চাবচং গচ্ছতি ভূরি প্রজ্ঞঃ।
    অর্থাৎ যে বিদ্বান বেদের দ্বারা ধর্ম জ্ঞান প্রাপ্ত হন,তি........ কখনোই বিচলিত হননা।
    সুত্তনিপাত ১০৫৯ এ গৌতম বুদ্ধের নিম্নোক্তি পালীতে পাওয়া যায়-
    য়ং ব্রাহ্মণং বেদেগুং অভিজনা,
    অকিংচনং কামভবে অসত্তং।
    শ্রদ্ধা হি সো ওঘমিমং অনাদি,
    নিণ্ণো চ পারং অখিলো অকংখো।।
    যার সংস্কৃত অনুবাদ-
    য়ং ব্রাহ্মণং বেদজ্ঞম্ অভিজ্ঞাতবান্
    অকিংচনং কামভবে অসক্তম্।
    শ্রদ্ধা হি স ওঘমিমম্ অতারীত্
    তীর্ণশ্চ পারম্ অখিলঃ অকাংক্ষঃ।।
    অর্থাৎ  যে বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে জানবে, তাঁর কাছে  যদি কোনো ধনসম্পদ না থাকে এবং সে যদি সাংসারিক কামনাতে আসক্ত না থাকে তবেই সে সত্যিকারের এই সংসার সাগর পার করতে পারবে। এখানে একজন সত্যিকারের বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণের প্রশংসা করেছেন।

    ➽ শিখ গুরুদের দ্বারা বেদের মহত্ব ➧
    শিখ ধর্মের প্রবর্তক গুরু নানক এবং অন্যান্য গুরুদের দ্বারা বেদের মহত্ব অনেক জায়গায় স্পষ্ট বর্ণিত হয়েছে.... উদাহরণস্বরূপ গুরু গ্ৰন্থ সাহেবের নিম্নোক্ত কথা গুলো দেখুন➠
    ১. ওঁ কার বেদ নিরমায়ে (রাগ রামকলী মহলা ১ ওঁ কার শব্দ ১)
    অর্থাৎ ঈশ্বর বেদ নির্মাণ করেছেন।
    ২. হরিআজ্ঞা হোয়ে বেদ,পাপ পুণ্য বিচারিআ।(মহলা ৫ শব্দ ১)
    অর্থাৎ ঈশ্বরের আজ্ঞা বেদ,যার দ্বারা মানুষ পাপ-পূণ্যের বিচার করতে পারে।
    ৩. সামবেদ,ঋগ্,যজুর,অথর্বণ,
    ব্রহ্ম মুখ মাইয়া হে ত্রৈগুণ।
    তাকী কীমত কীত কহ ন সকে,
    কো তিড় বোলে জিউ বোলাইবা।।(মহলা ১ শব্দ ১৭)
    এখানে চারবেদের নাম নিয়ে বলা হয়েছে যে, বেদের (মহত্ব) কেউ বলতে পারে না।যা অমূল্য এবং অনন্ত।
    ৪.চার বেদ চার খানী।।(মহলা৫ শব্দ ১৭)
    অর্থাৎ চার বেদ চার জ্ঞান কোষের সমান।
    ৫. বেদ বখান কহহি ইক কহিয়ে।
    ওহ বেঅন্ত অন্ত কিন লহিয়ে।।(মহলা ১ অধ্যায় ৩)
    অর্থাৎ বেদের মহিমার কি বর্ণন করা যায়? তা তো বেঅন্ত, তার অন্ত কিভাবে হবে?
    ৬. দীবা তলে অন্ধেরা জাই।
    বেদ পাঠ মতি পাপা খাই।
    উগবে সুরজ ন জাপে চন্দ,
    জহা গিয়ান(জ্ঞান) প্রগাস অজ্ঞান মিটন্ত।।
    অর্থাৎ বেদের জ্ঞানে অজ্ঞান মিটে যায় এবং বেদের পাঠে বুদ্ধি শুদ্ধ হয়ে পাপের বিনাশ হয়।
    ৭. অসংখ গ্ৰন্থ মুখি বেদ পাঠ।(জপ জী ১৭)
    অর্থাৎ অসংখ্য গ্ৰন্থ  থাকলেও বেদ পাঠ সবথেকে মুখ্য।
    ৮. বেদ বখিয়ান করত সাধুজন,
    ভাগহীন সমঝত নাংহী।।(টোডী মহলা ৫ শব্দ ১৭)
    অর্থাৎ সাধুরা বেদের ব্যাখা করে কিন্তু ভাগ্যহীন মানুষেরা কিছুই বুঝতে পারে না।
    ৯. কহত বেদা গুণন্ত গুণিয়া,
    সুণত্ বালা বহ বিধি প্রকারা।
    দৃঢন্ত সুবিদ্যা হরি-হরি কৃপালা।।(মহলা ৫/১৪)
    অর্থাৎ বেদ পাঠে উত্তম বিদ্যা এবং ঈশ্বরের কৃপা লাভ হয়।
    যে বেদের নিন্দা করে এবং বেদকে অসত্য মনে করে,গুরু গ্ৰন্থ সাহেবে তাঁর ক্ষেত্রে কবীর বলেছেন ➤
    “বেদ কতেব, কহহু মত ঝুঠে ঝুঠা জো ন বিচারে।”
    অর্থাৎ বেদকে কখনো অসত্য বলোনা। মিথ্যুকতো সেই, যে বিচার করে না।

    ➽ সুপ্রসিদ্ধ পারসী বিদ্বান দ্বারা বেদের  মহত্ব ➧
    সুপ্রসিদ্ধ পারসী বিদ্বান ফর্দূন দাদা চান B.A.LL.B.D.Tg. “Philosophy of Zoroastrian and comparative study of Religions” নামক গ্ৰন্থ বেদের বিষয়ে লিখেছেন➠
    “The Veda is a book of knowledge and wisdom, comprising the book of nature,the book of Religion,the Book of prayers,the Book of morals and so on. The word 'Veda'means wit, wisdom, knowledge and truly the Veda is condensed wit,wisdom and knowledge.”(P.100)

    ➽ আরব দেশের এক বিদ্বান দ্বারা বেদের মহত্ব ➧
    আরব দেশের এক বিদ্বান আরবীতে এক কবিতার মাধ্যমে বেদের গুণগান করেছেন যার বঙ্গানুবাদ নিম্নরূপ ➧
    ১. হে ভারতের ধন্যভূমি! তুমি আদরের যোগ্য কেননা তোমাতেই ঈশ্বর প্রথম সত্যজ্ঞানের প্রকাশ করেছেন।
    ২. ঈশ্বরীয় জ্ঞান এই চার বেদ আমাদের মানসিক চোখকে আকর্ষক এবং শীতল ঊষার জ্যোতি দেয়। পরমেশ্বর ভারতে ঋষিদের হৃদয়ে এই বেদের প্রকাশ করেছেন।
    ৩. যা পৃথিবীর সমস্ত জাতির জন্য উপদেশ দেয় যে, আমি যে বেদজ্ঞান দান করেছি তা তুমি অর্জন করো এবং বেদের অনুকূলে জীবন যাপন করো, অপরকেও এই জ্ঞান দান করো।
    ৪. এই চার বেদ হলো সেই সম্পদ যা পরমেশ্বর দিয়েছেন।
    ৫.  হে আমার ভাইয়েরা! এই চার বেদের মধ্যে সামবেদ এবং অথর্ববেদের আদর করো কেননা বেদই হলো মুক্তির শুভ সন্দেশ।
    ৬. এই চার বেদের মধ্যে ঋকবেদ এবং অথর্ববেদ আমাদের বিশ্বভ্রাতৃত্বের শিক্ষা দেয়।

    ➽ সুপ্রসিদ্ধ Mr. W. D. Brown দ্বারা বেদের মহত্ব ➧
    Mr. W. D. Brown নামক এক ইংরেজী বিদ্বান তাঁর নিজের লেখা “Superiority of the Vedic Religion” নামক গ্ৰন্থ এ বৈদিক ধর্ম এর ব্যাপারে লিখেছেন ➤
     "It (Vedic Religion) recognizes one god. It is a thoroughly scientific religion where religion and science meet hand in hand. Here theology is based upon science and philosophy."

    ➽ সুপ্রসিদ্ধ Professor Heeren দ্বারা বেদের মহত্ব ➧
    Professor Heeren নামক একজন ঐতিহাসিক বিদ্বান বেদের বিষয়ে লিখেছেন ➤
    “They (The Vedas) are without doubt the oldest works composed in Sanskrit. Even the most ancient Sanskrit works allude to the Vedas as already existing. The Vedas stand alone in their solitary splendour, standing as beacon of Divine Light for the onward march of humanity.(Historical Researches by Prof. Heeren(vol. 11 P.127)

    ➽ সুপ্রসিদ্ধ থোরিয়ো দ্বারা বেদের মহত্ব ➧
    আমেরিকার থোরিয়ো নামক একজন সুপ্রসিদ্ধ বিদ্বান লেখক বেদের সম্পর্কে বলেছেন ➤
    “What extracts from the Vedas I have read fall on me like the light of a higher and purer luminary which describes a loftier course through a purer stratum—free from particulars,simple, universal;the Vedas contain a sensible account of God.”(quoted here from “Mother America” by Swami Omkar P.9)

    ➽ সুপ্রসিদ্ধ Dr. James Cousins দ্বারা বেদের মহত্ব ➧
    আয়ারল্যান্ডের Dr. James Cousins নামক সুপ্রসিদ্ধ কবি এবং দার্শনিক “Path to Peace” নামক বইতে বৈদিক আদর্শের উচ্চতার বর্ণন করে বলেছেন ➤
    “On that (Vedic) ideal alone, with its inclusiveness which absorbs and annihilates the causes of antagonism,its sympathy which wins hatred away from itself,it is possible to rear a new earth in the image and from itself,it is possible to rear a new earth in the image and likeness of the eternal heavens.”('Path to peace' by Dr. James Cousins P.66)

    ➽ রুসের জগদ্বিখ্যাত Tolstoy এর বেদের প্রতি শ্রদ্ধা ➧
    রুস নিবাসী Leo Tolstoy জগতপ্রসিদ্ধ বিচারক এবং লেখক। Alexander sifman নামক Tolstoy সংগ্ৰহালয়ের অনুসন্ধান বিদ্বান “Leo Tolstoy and the Indian Epics” যে লেখাটা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল তার দ্বারা Leo Tolstoy এর বেদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। Sifman লিখেছেন➠
    “Leo Tolstoy was deeply interested in ancient Indian literature and its great epics. The themes of the Vedas were the first to attract his attention.”
    “Appreciating the profoundity of the Vedas, Tolstoy gave particular attention to those cantos which deal with the problems of ethics, a subject which interested in deeply. He subscribed to the idea of human love which pervades the Vedas,with their humanism and praise of peaceful labour. Tolstoy the artist was moreover delighted with the poetic treasure and artistic imagery which distinguish those outstanding Indian epics.”
    “He (Tolstoy) ranked the Vedas and their later interpretation—the Upanishads—with those perfected works of world art which have never failed to appeal to all nationalities in all epochs and which therefore represent true art.”
    “Tolstoy not only read the Vedas,but also spread their teachings in Russia. He included many of the sayings of the Vedas and the Upanishads in his collections 'Range of Reading', through of wise men's and others.”
    এইভাবে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন সুপ্রসিদ্ধ বিদ্বানগণ বেদের মহিমার বর্ণনা করেছেন।

    ⏩বেদের মহত্বের কারণ➽ 
    (১) বেদের মহত্বের কারণ এটাই যে,বেদের মধ্যে জ্ঞান,কর্ম, উপাসনার সুন্দর মেলবন্ধন রয়েছে।কেবলমাত্র জ্ঞান বা কর্মের দ্বারা মুক্তি হয় না। জ্ঞান কর্ম এবং উপাসনার মিলনেই মোক্ষ বা পরমানন্দ প্রাপ্ত হওয়া যায়। শ্রদ্ধা এবং মেধা(শুদ্ধ বুদ্ধি বা তর্ক)এর সুন্দর মিলন বৈদিক ধর্ম শেখায়।
     বেদ “শ্রদ্ধাং প্রাতর্হবামহে শ্রদ্ধাং মধ্যংদিনং পরি।শ্রদ্ধাং সূর্যস্য নিম্রুচি শ্রদ্ধে শ্রদ্ধাপয়হে নঃ।” (ঋগ্বেদ ১০/১৫১/৫)
     মন্ত্রের দ্বারা প্রাতঃ, মধ্যাহ্ন এবং সূর্যাস্তের সময় শ্রদ্ধার ধারণ করতে এবং জীবনকে শ্রদ্ধাময় বানানোর জন্য উপদেশ করা হয়েছে।সাথে সাথেই আমাদের সর্বদা মেধা বা শুদ্ধ বুদ্ধি ধারনের কথা বলা হয়েছে।
    “মেধাং সায়ং মেধাং প্রাতর্মেধাং মধ্যন্দিনং পরি।
    মেধা সূর্যস্য রশ্মিভির্বচসা বেশয়ামহে।।”(অথর্ববেদ ৬/১০৮/৫)
     মন্ত্রে এই বিষয় স্পষ্ট হয়েছে।প্রাতঃ, মধ্যাহ্ন,সায়ং সূর্যের কিরণের সাথে সাথে মেধা অথবা শুদ্ধ বুদ্ধি যেন আমরা নিজেদের মধ্যে ধারণ করি। বৈদিক ধর্মের শ্রদ্ধা অন্ধবিশ্বাস নয় শ্রত্+ধা অর্থাৎ "সত্যকে ধারণ করা"। শুদ্ধ বুদ্ধির দ্বারা সত্য জ্ঞান প্রাপ্ত করে তার সম্পূর্ণতা নিজের মধ্যে ধারণ করা, কঠিন থেকে কঠিনতর আপত্তি এবং প্রলোভন এলেও সত‍্যকে অস্বীকার না করাই হচ্ছে শ্রদ্ধা।বেদোক্ত ধর্ম এইভাবেই শ্রদ্ধা এবং মেধা (শুদ্ধ বুদ্ধি) র মিলনের উপদেশ দেয়।
    “অগ্নয়ে সমিধামাহার্য় বৃহতে জানবেদসে।
    স মে শ্রদ্ধাং মেধাং চ জানবেদাঃ প্রয়চ্ছতু।।”(অথর্ববেদ ১৯/৬৪/১)
    ইত্যাদি মন্ত্রের এটাই তাৎপর্য।
    “মূর্ধানমস্য সংসীব্যাথর্বা হৃদয়ং চ য়ত্।”(অথর্ববেদ ১০/২/২৬)
     মন্ত্রের দ্বারা জ্ঞানীর জন্য মস্তিষ্ক এবং হৃদয় কে কাজ করার জন্য উপদেশ দেয় যা অত্যন্ত মহত্বপূর্ণ।
    ধর্মের বিষয়ে তর্ক করলে তা নাস্তিকতার চিহ্ন বলে মনে করা হয়। কেবলমাত্র বিশ্বাস এর উপর নির্ভর করা হয়,যার ফলে সমাজে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন অন্ধবিশ্বাস। কিন্তু বেদোক্ত ধর্ম কখনোই কোনো অন্ধবিশ্বাস বা কুসংস্কার বা যুক্তিবিরোধী কথায় বিশ্বাস করে না।ইহার বিশেষতা এটাই, প্রত্যেক মন্ত্রে বুদ্ধি এবং যুক্তিতর্ক এর মাধ্যমে সত্যকে স্বীকার করার কথা বলা হয়েছে।
    তর্কের বিষয়ে বিভিন্ন সংস্কৃত সাহিত্যে বিভিন্ন কথা পাওয়া যায়-

    (I) মহাভারতে লেখা আছে নাস্তিক,সমস্তকিছুতেই শঙ্কা প্রকাশ করে,বেদ নিন্দুক, মূর্খ নিজেকে পন্ডিত মনে করে এবং শেয়ালের যোনি প্রাপ্ত হন।(মহাভারত শান্তি পর্ব ২৮০)

    (II) মনু লিখেছেন যে ব্যক্তি তর্কের আশ্রয় নিয়ে বেদের অপমান করে,সে নাস্তিক এবং বেদ নিন্দুক।(২/১১)
    যখন মানুষ তর্ক ছেড়ে শ্রদ্ধার আশ্রয় নেয় তখন তা অন্ধবিশ্বাসে পরিনত হয়।এইভাবে যখন শ্রদ্ধা ছেড়ে তর্কের আশ্রয় নেয় তা কুতর্কীতে পরিনত হয়।এজন্য এটাই আবশ্যক তর্ক এবং শ্রদ্ধা এই দুটোকেই নিজেদের সীমার মধ্যে রাখা উচিত।

    (২) বেদের  মহত্বের দ্বিতীয় প্রধান কারণ হচ্ছে এখানে শারীরিক, মানসিক এবং আত্মিক শক্তির সমানভাবে বিকাশের জন্য জোর দেওয়া হয়েছে। বেদের অনুসারে এই সমবিকাস হলো উন্নতির মূলমন্ত্র।
    “মনস্ত আপ্যায়তাং বাক্ ত আপ্যায়তাং প্রাণস্ত আপ্যায়তাং চক্ষুস্ত আপ্যায়তাং শ্রোত্রং ন আপ্যায়তাম্।।(যজুর্বেদ ৬/১৫)

    “বাঙ্ ম আসন্ নসোঃ প্রাণশ্চক্ষুরক্ষ্ণোঃ শ্রোত্রং কর্ণয়োঃ।।
    অপলিতাঃ কেশা অশোণা দন্তা বহু বাহ্মোর্বলম্।।
    ঊর্বারোজা জঙ্ঘয়োর্জবঃ পাদয়োঃ প্রতিষ্ঠা অরিষ্টানি মে সর্বাত্মা নিভৃষ্টঃ‌।।”(অথর্ববেদ ১৯/৬০/১/২)
    ইত্যাদি মন্ত্রে এই শারীরিক মানসিক ও আত্মিক শক্তির সমানভাবে বিকাশের জন্য প্রতিপাদন এবং সেই অর্থে প্রার্থনাদির উপদেশ আছে এবং একেই শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্য বলা হয়েছে।

    (৩) বেদের মহত্বের তৃতীয় কারণ হলো বেদে মধ্যমার্গের প্রতিপাদন তথা উহার সমন্বয়াত্মক উপদেশ আছে। সমাজে প্রায় দেখা যায় মানুষ মধ্যমার্গের অবলম্বন না করে কোনো না কোনো বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে পড়ে যার জন্য তাঁকে বিভিন্ন কষ্ট ভোগ করতে হয়। উদাহরণস্বরূপ অনেক মানুষ আছে যারা ব্যাক্তিগত উন্নতিতে সন্তুষ্ট থাকে কিন্তু সামাজিক উন্নতির দিকে একটুও দেখে না।আবার অনেকে আছেন যারা পর্যাপ্ত রুপে নিজেদের শারীরিক মানসিক ও আত্মিক শক্তির সমানভাবে বিকাশ না করে কেবল অপরের উন্নতির ব্যাপারে তৎপর থাকেন। বাস্তবে যদি দেখি তাহলে এই দুটোই আবশ্যক। যজুর্বেদ ৪০ অধ্যায়ে  সম্ভূতি এবং অসম্ভূতি নিয়ে সামাজিক এবং ব্যক্তিগত ভাবের বর্ণনা করে বলা হয়েছে➙
    “অন্ধংতমঃ প্রবিশন্তি য়ে সংভুতিমুপাসতে।
    ততো ভূয় ইব তে তমো য় উ সংভূত্যাং রতাঃ।।”(যজুর্বেদ ৪০/৯)
    অর্থাৎ যে কেবল অসংভূতি-ব্যাক্তিগত উন্নতির জন্য মগ্ন থাকে সে অন্ধকারে পতিত হয় এতে কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু যে ব্যাক্তিগত উন্নতিতে মনোযোগ না দিয়ে কেবল সামাজিক উন্নতির জন্য মগ্ন থাকে সেও অন্ধকারে পতিত হয়। এই জন্য বেদ অসম্ভূতি এবং সম্ভূতি অর্থাৎ ব্যাক্তিগত এবং সামাজিক এই দুটোরই উন্নতির জন্য মনোযোগ দেওয়ার উপদেশ দেয়।

    (৪) বেদের শিক্ষা ভোগ এবং ত্যাগ এই দুই বিষয়ের
    “ঈশবাস্যমিদং সর্ব,য়ত্ কিং চ জগত্যাং জগত্।
    তেন ত্যক্তেন ভুংজীথা মাগৃধঃ স্বিদ্ধনম্।।”(যজুর্বেদ ৪০/১)
    পরমেশ্বর এই জগতের সমস্ত বস্তুতে বিদ্যমান এইজন্য উনার দেওয়া বস্তুর তুমি ত্যাগ ভাবনা পূর্বক ভোগ করো। লোভ করো না। এই কথার বিচার করো যে, এই সমস্ত ধনসম্পদ যা তুমি নিজের বলে অভিমান করছো সেটা কার? ইহা প্রজাপতি পরমেশ্বরের। পরোপকারের কার্যে এই ধনসম্পদ এর অধিক থেকে অধিকতর ব্যবহার করে তুমি আবশ্যকতা অনুযায়ী ঈশ্বর প্রদত্ত সাংসারিক বস্তুর সঠিক উপভোগ এবং করলে তার থেকে কোনো পাপ হয় না।এর থেকে বড়ো আর অধিক উপযোগী শিক্ষা কি হতে পারে?

    (৫)বেদের মহত্বের পঞ্চম কারণ হলো বেদের শিক্ষা তর্ক এবং বিজ্ঞান সম্মত।
    ইংল্যান্ডের Mr. W. D. Brown এর লেখা যা আগেই বলেছি তা এক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
    "Vedic Religion is a throughly scientific religion where religion and science meet hand to hand. Here theology is based upon science and philosophy."

    ঋষি অরবিন্দ স্বামী দয়ানন্দ সম্পর্কে বলেছেন➠
    "There is nothing fantastic in Dayananda idea that Veda contains truth of science as well as truth of reigion. I will even add my own conviction that Veda contains the other truths of a science the modern world does not at all possess and in that case,Dayananda has rather understated than overstated the depth and range of the Vedic wisdom."("Dayannda and the Veda"by Shri Arvindo)

    মহারাষ্ট্রের বিদ্বান শ্রী নারায়নরাও পাবগী কৃত "The Vedic Father of Geology"— এই বইতে তিনি লিখেছেন➠
    I may take this Opportunity to remind The Reader, without fear of contradiction, that the Vedas contain many things not yet known to anybody, as they form a mind of in exhaustible literary wealth, that has only partially been opened and has still remained unexplored."("The Vedic Father of Geology" Introduction P. vi)

    শ্রী পাবগীর ''Self Government in Ancient India"—"Vedic and Post Vedic" তথা "Vedic India"—"Mother of Parliaments" নামক গ্ৰন্থ পড়ার যোগ্য যেখানে তিনি স্বরাজ্য এবং প্রজাতন্ত্র শাসন-পদ্ধতির মূল বৈদিক ভারতকে বলেছেন এবং বেদের বিষয়ে বলেছেন➠
    "The Veda is the fountainhead of knowledge,the prime source of inspiration,nay, the grand repository of petty passages of Divine Wisdom and Even Etarnal Truth."(Vedic India p. 136)

    জীব বিজ্ঞান বা Biology র মূল বেদে কিভাবে বলা হয়েছে এর জন্য পাঠক "The Vedic Gods—as Figures of Biology" by Dr. V. G. Rele L.M.F.S.,F.C.P.S. নামক বইটি পড়ুন।

    ভৌতবিজ্ঞান এবং রসায়ন বিজ্ঞানের মূল বেদে যদি জানতে চান তাহলে শ্রী পণ্যম্ নারায়ণ গৌড M.A.B.S.C "Introduction to the Massage of the Vedas as the 20th century" নামক পুস্তক পড়ুন। যার বিষয় নির্দেশ করে লেখক লিখেছেন-"Proving that the Vedas as treatise on the exact Sciences."
    অর্থাৎ এই বইতে বলা হয়েছে বেদ শুদ্ধ বিজ্ঞানের বই। 

    ঋকবেদ এবং যজুর্বেদের বিষয়ে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি দিয়ে বিচার করে এই বইতে লেখক লিখেছেন➠
    "The Rigveda deals with the theorems and experiments, while the process of preparing the reagents and apparatus is recorded in the Yajurved which is in effect;a laboratory guide."
    এছাড়াও আরোও অনেক বিদ্বানগণ বেদের বিজ্ঞানের ব্যাপারে অনেক বই লিখেছেন।

    Jacolliot নামক ফ্রান্সের এক বিদ্বান তাঁর নিজের লেখা বই "The Bible in India"বইতে বিভিন্ন মত-সম্প্রদায়ের গ্ৰন্থের সাথে বেদের তুলনা করে বলেছেন➠
    "Astonishing fact! The Hindus Revelation(Veda) is of all Revelation the only one whose ideas are in perfect harmony with modern science,as it proclaims the slow and gradual formation of the world."("The Bible in India" by Jacolliot Vol II.chap. 1)

    আমেরিকার বিদুষী মহিলা Mrs. Wheeler Wilox একটি লেখা লিখেছিলেন যা নিম্নরূপ➠
    "We have all heard and read about the ancient religion of India. It is the land of the Great Vedas- the most remarkable works containing not only religious ideas for a perfect life, but also facts which all the science has since proved true. Electricity, Radium, Electrons, Airships all seems to be known to the seers who found the Vedas."

    (৬) বেদের মহত্বের পরবর্তী কারণ হলো বেদের শিক্ষা সার্বভৌমত্ব এবং নিষ্পক্ষতা প্রকাশ করে➙
    দৃতে দৃংহ মা মিত্রস্য মা চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষন্তাম্।
    “মিত্রস্যাহং চক্ষুষা সর্বাণি ভূতানি সমীক্ষে,মিত্রস্য চক্ষুষা সমীক্ষামহে।।”(যজুর্বেদ ৩৬/১৮)
    ইত্যাদি মন্ত্রের দ্বারা সকল প্রাণীকে প্রেমময় দৃষ্টির মাধ্যমে দেখার উপদেশ দেওয়া হয়েছে। এই বিশ্ববন্ধুত্বের ভাবনার দ্বারাই বিশ্বশান্তি স্থাপন সম্ভব।
    নিষ্পক্ষতার শিক্ষা➙
    “প্রিয়! সুকৃত প্রিয় ইন্দ্র মনায়ুঃ প্রিয়ঃ সুপ্রাদীঃ প্রিয়ো অস্য সোমী।”(ঋগ্বেদ ৪/২৫/৫)
    অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রিয় সেই হয় যে সর্বদা উত্তম কর্ম করে।যে মননশীল অথবা বিচারশীল হয় সেই পরমেশ্বরের প্রিয় হয় যে উত্তম রীতির দ্বারা সমস্ত প্রাণীর রক্ষাকারী হয় এবং যে স্বয়ং শান্তিপূর্ণ ভাবে শান্তির প্রচার করে।এমন ব্যাক্তিই ঈশ্বরের কাছে প্রিয় হয়,তাকে সে যে দেশ বা স্থান থেকে হোক না কেন। বেদের এই সার্বভৌম এবং নিষ্পক্ষতার শিক্ষা যদি অন্যান্য মত-সম্প্রদায়ের সাথে তুলনা করা যায় তবে আকাশ পাতাল পার্থক্য।


    🙏🙏🙏নমস্কার🙏🙏🙏