মনুস্মৃতি ও নারী - "মনুস্মৃতি নারী বিরোধী" এই বক্তব্যের খণ্ডন।
কিছু বিধর্মী, নাস্তিক, নারীবাদী ও বামপন্থীদের দাবী এই যে মনুস্মৃতি নারীদের অধিকার কেড়ে নিয়েছে, তাদেরকে পুরুষের দাস বানিয়েছে।
এই প্রবন্ধে আমি মহর্ষি মনুর অনুপম কীর্তি মনুস্মৃতির উপর আরোপিত নারী বিরোধী এবং নারী অবমাননাকর দাবিগুলোর বিশ্লেষণ করবো।
প্রথমেই বলে রাখি, মনুস্মৃতিতে কিছু প্রক্ষিপ্ত শ্লোক আছে এবং সেগুলো বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে খুব সহজেই সনাক্ত করা যায় এবং শুদ্ধ গুলিও নির্ধারণ করা যায়।
যা বেদবাহ্যাঃ স্মৃতয়ো যাশ্চ কাশ্চ কুহষ্টয়ঃ।
সর্বাস্তা নিষ্ফলাঃ প্রেত্য তমোনিষ্ঠা হি তাং স্মৃতাঃ।।
(মনুস্মৃতি ১২।৯৫)
উত্পদ্যন্তে চ্যবন্তে চ যান্যতোন্যানি কানিচিত।
তান্যর্বাককালিকতয়া নিষ্ফলান্যনুতানি চ।।
(মনুস্মৃতি ১২।৯৬)
অর্থঃ যে সকল স্মৃতি বেদবহির্ভূত, আর যে সকল শাস্ত্র বেদবিরুদ্ধ কুতর্কমূলক, সে সকল শাস্ত্র নিষ্ফল জানিবে, সেই সকল শাস্ত্র তমঃকল্পিত মাত্র। ৯৫
যে সকল শাস্ত্র বেদমূলক নয়, বরং পুরুষ-কল্পিত, কালক্রমে তারা উৎপন্ন হয় এবং বিনষ্ট হয়। আধুনিক এসব শাস্ত্রকে নিষ্ফল ও মিথ্যা বলে জানবে।৯৬
সুতরাং, মনুস্মৃতিও প্রক্ষিপ্ত হতে পারে!!! এবং বেদবিরুদ্ধ কোনো শ্লোক প্রকৃত মনুস্মৃতিতে থাকা সম্ভব নয়। আর তাই বেদ বিরুদ্ধ কিছু মনুস্মৃতিতে খুজে পেলে তা অবশ্যই বর্জনীয়।
মেধাতিথির মনুস্মৃতির ভাষ্য বলে পরিচিত যে পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায় সেখানে লেখা আছেঃ
মান্যা কাপি মনুস্মৃতিস্তদুচিন্তা ব্যাখ্যাপি মেধাতিথে।
সা লুপ্তৈ বিধেবশাত্ক্চচিদপি প্রাপ্যং ন তত্পুস্তকম্।।
ক্ষোণীন্দ্রো মদন সহারণ সুতো দেশান্তরাদাহৃতৈ।
জীর্ণোদ্ধরমচীকরত্ তত ইতস্তত্পুস্তকোলিখিতেঃ।।
(মেধাতিথিরচিত মনুভাষ্য সহিত মনুস্মৃতেরূপোদ্-ঘাতঃ)
অর্থাৎ, প্রাচীন কালে প্রামাণিক মনুস্মৃতি ছিলো এবং মেধাতিথি তার উচিত ব্যাখ্যা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত ঐ পুস্তক লুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো। তখন রাজা মদন ইতস্তত বিভিন্ন পুস্তক থেকে মনুস্মৃতির জীর্ণোদ্ধার করিয়েছিলেন।
(সূত্রঃ স্ত্রীওকা গায়ত্রী অধিকার; শ্রীরাম শর্মা আচার্য; পৃ ২৯)
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে বর্তমানে প্রাপ্ত মনুস্মৃতি প্রাচীন মনুস্মৃতি নয়। বরং বিলুপ্ত মনুস্মৃতির পুনরুদ্ধারের চেষ্টায় রাজা মদনের করা একটি সংকলন।
এই সংকলনে মূল মনুস্মৃতির শ্লোক যেমন আছে তেমনি ভাবে সংকলনের ত্রুটিজনিত কারণে ঢুকে যাওয়া প্রক্ষিপ্ত শ্লোকও আছে।
ডঃ সুরেন্দ্রকুমারজী মনুস্মৃতির শ্লোকগুলো একটা একটা করে বিশ্লষণ করে প্রক্ষিপ্ত শ্লোকগুলো খুজে বের করেছেন এবং তাদের প্রক্ষিপ্ততার প্রমাণ পেশ করেছেন।
প্রক্ষিপ্ত শ্লোকগুলি বাদ দিলে মহর্ষি মনুর মনুস্মৃতি একটি অসাধারন রচনা। বেদের পর মনুস্মৃতিই নারীদের সবচেয়ে বেশি সম্মান দিয়েছে। আধুনিক কালের নারীবাদীরাও নারীকে এমন উচ্চ স্থান দিতে সক্ষম হননি।
মনুস্মৃতি ৩/৫৬:
যত্র নার্য্যস্ত পূজন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ।
যতৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্ব্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।
অর্থঃ যে কুলে স্ত্রীলোকেরা বস্ত্রালঙ্কারাদি দ্বারা পূজিত হয়েন, তথায় দেবতারা প্রসন্ন থাকেন। আর যে কুলে স্ত্রীদিগের অনাদর হয়, সে বংশে সকল ক্রিয়া নিষ্ফল হইয়া যায়।
এই শ্লোকে যে শুধু নারী জাতির প্রশংসা করা হয়েছে তা নয়; বরং প্রকৃত বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। যে ব্যক্তি মাতৃশক্তির প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং মাতৃজাতির অবমাননাকারীদের কঠিন জবাব দিতে প্রস্তুত তাদের জন্য এই শ্লোকটি অমৃত স্বরূপ এবং প্রকৃতির এই নিয়ম দেশ কাল পাত্র ভেদে সমস্ত মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য।
আমরা এতোই নির্লিপ্ত যে শতশত বছর ধরে এই মনুস্মৃতির অপমান আমরা চেয়ে চেয়ে দেখছি। ভারতীয় সংস্কৃতি ধ্বংস করতে সচেষ্ট বিভিন্ন মহলের এই অপতৎপরতা সত্ত্বেও আমরা চুপ করে বসে আছি এবং পরিস্থিতি আরো খারাপ করে ফেলেছি। অবশ্য, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর প্রচেষ্টায় সনাতন সমাজের কিছুটা উন্নতি হয়েছে এবং মানুষ বেদের পবিত্র বাণী গ্রহণ করতে শুরু করেছে।
মৌলবাদী ভাবধারার মুসলিম দেশগুলোতে নারীদের সম্মান পুরুষের অর্ধেক বা তার চেয়ে অনেক কম মনে করা হয়। শরিয়া আইন দ্বারা পরিচালিত এসব দেশে নরীদের কাছে পৃথিবী নরকের চেয়ে যন্ত্রণাদায়ক। আর নারীদের পুরুষের জন্য তৈরী হওয়া ভোগ্যপণ্য হিসেবে বিবেচনাকারী বাইবেল ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলোতে শত শত বছর ধরে নারীর অধিকার হরণ করে যাচ্ছে। কিন্তু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের এসব বিষয়ে কথা উঠলে গর্তের ভেতর থেকেও টেনে তোলা যায়না।
ইউরোপীয় দেশগুলিতে সংস্কারের হওয়া প্রবাহিত হওয়ার কারণে মানুষ এই নিকৃষ্ট বাইবেলই বর্জন করেছে। এছাড়া তাদের সমাজকে দ্রুত কুসংস্কার মুক্ত করার কোনো উপায় ছিলোনা। এসব দেশের মানুষ বাইবেল বর্জন করেছে, কিন্তু নারীদের যথাযথ মর্যাদা দিতে তারা সক্ষম হয়েছে কি?
এসব দেশে নারী এখন উপভোগের বস্তু, পুরুষের লালসা মেটানোর জন্য নারীদের কত আকর্ষণীয় করা যায় এটাই এখন মাস্টারমাইণ্ডদের পরিকল্পনার বিষয়। এসব কারণেই নারীরা এসব দেশেও নিরাপত্তা ও আত্মসম্মানের জন্য লড়াই করছে।
আসুন মনুস্মৃতি থেকে নারীদের বিষয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ন শ্লোক দেখে নিই।
পরিবারে মেয়েদের গুরুত্বঃ
মনুস্মৃতি ৩/৫৫:
পিতৃভির্ভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দ্দেবরৈস্তথা।
পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহু কল্যাণমীপ্সুভিঃ।।
অর্থঃ কন্যাকে বরই কেবল বিবাহের সময় ধন দিবেন এমত নহে বিবাহের পরেও কি পিতা কি ভ্রাতা কি পতি কি দেবর ইহারা সকলেই যদি অতুল কল্যানের অভিলাষ করেন তবে উহাদিগকে ভোজনাদি দ্বারা পূজা করিবেন ও বস্ত্র অলঙ্কারদি দ্বারা ভূষিত করিবেন।
মনুস্মৃতি ৩/৫৭:
শোচন্তি জাময়ো যত্র বিনশ্যন্ত্যাংশু তৎকুলম।
ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্দ্ধতে তদ্ধি সর্ব্বদা।।
অর্থঃ যে কুলে ভগিনী ও গৃহস্তের সপিণ্ড স্ত্রী, পত্নী, কন্যা, পুত্রবধু প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা ভূষণাচ্ছাদনাভাবে দুঃখিত হয়, তৎকুল শীগ্র নির্ধ্বন হইয়া যায় এবং দৈব ও রাজাদি দ্বারা পীড়িত হয়। আর যে কূলে স্ত্রীগণ ভোজনাচ্ছাদনাদি প্রাপ্তিতে সন্তুষ্ট থাকে সে কুল সর্বদা বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।
মনুস্মৃতি ৩/৫৮:
জাময়ো যানি গেহানি শপন্ত্যপ্রতিপূজিতাঃ।
তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যান্তি সমস্ততঃ।।
অর্থঃ ভগিনী, পত্নী পুত্রবধু প্রভৃতি স্ত্রীলোকেরা অপূজিত হইয়া যে কুলে শাপ প্রদান করে, সেই কুল এমনভাবে বিনাশ প্রাপ্ত হয় যেনো সবাইকে একত্রে বিষ প্রদান পূর্বক তাদের পুরো কুল ধ্বংশ করা হয়েছে।
মনুস্মৃতি ৩/৬০:
সন্তুষ্টো ভার্য্যয়া ভর্ত্তা ভর্ত্রা ভার্য্যা তথৈব চ।
যস্মিন্নেব কুলে নিত্যাং কল্যানং তত্র বৈ ধ্রুবম্।।
অর্থঃযে কুলে স্বামী-পত্নীতে ও পত্নী-স্বামীতে সন্তুষ্ট থাকেন, সে কুলে নিশ্চই সর্বদা কল্যান পরিবর্ধিত হয়।
মনুস্মৃতি ৯/২৬ঃ
‘প্রজনার্থং মহাভাগাঃ পূজার্হা গৃহদীপ্তয়ঃ।
স্ত্রীয়ঃ শ্রিয়শ্চ গেহুষু ন বিশেষোহস্তি কশ্চন।।
অর্থঃ স্ত্রীলোক সন্তান প্রসব ও পালন করে বলে তারা অত্যন্ত সৌভাগ্যবতী; এরা গৃহের দীপ্তি অর্থাৎ প্রকাশস্বরূপ হয়। এই কারণে, স্ত্রীলোকদের সকল সময়ে সম্মান-সহকারে রাখা উচিত, বাড়িতে স্ত্রী এবং শ্রী- এদের মধ্যে কোনও ভেদ নেই।
মনুস্মৃতি ৯/২৮:
অপত্যং ধর্ম্মকার্য্যাণি শুশ্রূষা রতিরুত্তমা।
দারাধীনস্তথা স্বর্গঃ পিতৃণামাত্মনশ্চ হ।।
অর্থঃ সন্তান উৎপাদন, অগ্নিহোত্রাদি যাগযজ্ঞ এবং আত্মশুশ্রূষা, উত্তম রতি এবং পিতৃগণের ও আপনার স্বর্গলাভ এ সকল কার্য্য পত্নী দ্বারাই নিষ্পন্ন হয়।
মনুস্মৃতি ৯/৯৬:
প্রজনার্থাং স্ত্রিয়ঃ সৃষ্টাঃ সন্তানার্থাঞ্চ মানবাঃ।
তস্মাৎ সাধারণো ধর্ম্মঃ শ্রুতৌ পত্ন্যা সহোদিতঃ।।
অর্থঃ বিধাতা গর্ভগ্রহণার্থ স্ত্রী সৃষ্টি করিয়াছেন, গর্ভধান জন্য পুরুষ সৃষ্টি করিয়াছেন, যেমন গর্ভৎপাদনকার্য্য পত্নী সহকারে নিষ্পন্ন হয়, এমত অগ্ন্যাধানাদি ধর্ম্মকর্ম্ম পত্নী সহিত সম্পন্ন হয়, এজন্য সর্ব্বদা পত্নীকে পোষণ করিবেন।
মনুস্মৃতি ৪/১৮০:
মাতাপিতৃভ্যাং যামীভির্ভ্রাত্রা পুত্রেণ ভার্য্যয়া।
দুহিত্রা দাসবর্গেণ বিবাদং ন সমাচরেৎ।।
অর্থঃ মাতা পিতা ভগিনী পুত্রবধু প্রভৃতি ভ্রাতা পুত্র পত্নী কন্যা ও ভৃত্যবর্গ ইহাদিগের সহিত বিবাদ করিবেক না।
মনুস্মৃতি ৯/৪:
‘কালেহদাতা পিতা বাচ্যো বাচ্যশ্চানুপযন্ পতিঃ।
মৃতে ভর্তরি পুত্রস্তু বাচ্যো মাতুররক্ষিতা।।’
অর্থঃ বিবাহ-যোগ্য সময়ে পিতা যদি কন্যাকে পাত্রস্থ না করেন, তাহলে তিনি লোকমধ্যে নিন্দনীয় হন; স্বামী যদি প্রাপ্তবয়স্কা পত্নীর সাথে সঙ্গম না করেন, তবে তিনি লোকসমাজে নিন্দার ভাজন হন। এবং স্বামী মারা গেলে পুত্রেরা যদি তাদের মাতার রক্ষণাবেক্ষণ না করে, তাহলে তারাও অত্যন্ত নিন্দাভাজন হয়।
বহুবিবাহ পাপঃ
মনুস্মৃতি ৯/১০১:
অন্যোন্যস্যাব্যভিচারো ভবেদামরণান্তিকঃ।
অর্থঃ স্বামী স্ত্রী ধর্ম্মার্থকামবিষয়ে পরষ্পর মরণ পর্যন্ত একত্রে থাকিবে।( অর্থৎ, ব্যাভিচার থেকে রক্ষা পেতে স্বামী স্ত্রী একসাথে বসবাস করা কর্তব্য)
স্ত্রীর স্বাধিকারঃ
মনুস্মৃতি ৯/১১:
‘অর্থস্য সংগ্রেহে চৈনাং ব্যয়ে চৈব নিযোজয়েৎ।
শৌচে ধর্ম্মেহন্নপক্ত্যাঞ্চ পারিণাহ্যস্য বেক্ষণে।।’
অর্থঃ (স্বামী) অর্থের সংগ্রহ, ব্যায়, দ্রব্যসামগ্রীর শুদ্ধি ও আত্মশরীরশুদ্ধি, স্থাপিত অগ্নির শুশ্রুষাদিকার্য্য এবং গৃহোপকরণের পর্য্যবেক্ষণ, এই সকল বিষয়ে স্ত্রীর উপর ভারার্পণ করিবেন, ইহা হইলে সর্ব্বদা কার্য্যব্যপ্রতায় কুকর্ম্মপ্রসঙ্গ ঘটিবার সম্ভবনা নাই।
এই শ্লোক থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে বৈদিক আচার অনুষ্ঠান পালনের পূর্ণ অধিকার রয়েছে এবং সাথে সাথে বর্তমানে মনুস্মৃতি নিয়ে প্রচলিত সকল অপপ্রচার মুখ থুবড়ে পড়ে। শুধু তাই নয় নারীদের এসব আচার পালনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে এবং যারা নারীর এই অধিকার লঙ্ঘন করে তারা বেদ মনুস্মৃতি এবং পুরো মানবতার বিরুদ্ধে।
মনুস্মৃতি ৯/১২:
অরক্ষতাগৃহে রুদ্ধাঃ পুরুষৈরাপ্তকারিভিঃ।
আত্মানমাত্মনা যাস্তু রক্ষেযুস্তাঃ সুরক্ষিতাঃ।।
অর্থঃ যে স্ত্রী দুঃশীলতায় আত্মাকে রক্ষণ না করে, আপ্ত পুরুষেরা(যেমনঃ বাবা, ভাই, পতি, পুত্র) গৃহ মধ্যে সংরোধ করিয়া রাখিলেও সে অরক্ষিতা হয়। তবে যে স্ত্রী আপনা আপনি আত্মাকে রক্ষা করে সেই স্ত্রী সুরক্ষিতা হয়।
এই শ্লোকের তাৎপর্য এই যে, যারা নারীদের সুরক্ষার জন্য ঘরে রাখতে চায় তাদের চিন্তা নিরর্থক। বরং নারীরা যথাযথ প্রশিক্ষণ ও দিকনির্দেশনা পেলে নিজেদের রক্ষা নিজেরা করতে পারে।
এই শ্লোকে এটাও প্রতীমান হয় যে, নারীদের পবিত্র রাখার কথা ভেবে যারা তাদের চার দেয়ালের ভেতর আটকে রাখতে চায় তাদের চেষ্টা বৃথা। নারীর চরিত্র কেবল তখনি ভালো থাকবে যখন তারা নিজেরা নিজেদের মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে।
নারী জাতির সুরক্ষাঃ
মনুস্মৃতি ৯/৬:
ইমং হি সর্ব্ববর্ণানাং পশ্যন্তোধর্ম্মমুত্তমং।
যতন্তে রক্ষিতুং ভার্য্যাং ভর্ত্তারোদুর্ব্বলাঅপি।।
অর্থঃ স্ত্রীর রক্ষণরূপ ধর্ম্ম সকল ধর্ম হইতে উৎকৃষ্ট; ইহা (ব্রাহ্মণাদি) সকল বর্ণ জানিয়া অন্ধ পঙ্গু প্রভৃতি দূর্ব্বল ভর্ত্তারাও আপন আপন স্ত্রীকে রক্ষা করিবার জন্য যত্ন করিবে।
মনুস্মৃতি ৯/৫:
সূক্ষোভ্যোহপি প্রসঙ্গেভ্যঃ স্ত্রীয়ো রক্ষ্যা বিশেষতঃ।
দ্বায়োর্হি কুলয়োঃ শোকমাবহেয়ুররক্ষিতাঃ।।
অর্থঃ স্ত্রীজাতিকে অতি সামান্য দুঃসঙ্গ হইতেও যত্নপূর্বক রক্ষা করিবে, কারণ এবিষয়ে সমান্যতম অবহেলা করিলে সেই স্ত্রী পিতৃ-পতি উভয় কুলেরই সন্তাপের কারণ হয়।
মনুস্মৃতি ৫/১৪৯:
পিত্রা ভর্ত্ত্রা সুতৈর্ব্বাপি নেচ্ছেদ্বিরহমাত্মনঃ।
এষাং হি বিরহেণ স্ত্রী গর্হ্যে কুর্য্যাদুভে কুলে।।
অর্থঃ পিতা, স্বামী, পুত্র ইহদিগের হইতে স্ত্রীলোক কখন বিচ্ছিন্ন হইবে না। স্ত্রীলোক বিযুক্ত হলে তা পতিকুল ও পিতৃকুলের জন্য নিন্দনীয় হয়।
তবে এই শ্লোকের অর্থ এমন নয় যে, মনু নারীকে দাসী করে রাখার কথা বলেছে। নারীদের স্বাধীনতার পক্ষে যে মনু ছিলেন তা উপরে ৯/১২ শ্লোকে দেখানো হয়েছে। এখানে নারীদের সামাজিক নিরাপত্তার কথা বলা হয়েছে। যখন পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার মুসলিমরা আমাদের উপর বর্বর অক্রমণ চালিয়েছিলো তখন আমাদের দেশের পুরুষরা মা-বোনদের সম্মান রক্ষা করার জন্য তাদের জীবণ বলিদান দিয়েছিলো। মহারাণা প্রতাপের বীরত্বগাথা এবং আল্হা উদালের বলিদানের গল্পগুলি আজো আমরা গর্বের সাথে স্মরণ করি।
আমাদের সংস্কৃতির এমন মহান হতিহাস সত্ত্বেও আমরা এখনো নারীদের ঘরে আবদ্ধ করে রেখেছি, অথবা যারা বাইরে বের হতে পারে তাদেরকেও ভোগের বস্তু হিসেবে বানিজ্যিকরণ করেছি। আমরা যদি এভাবে আমাদের সংস্কারকে অঘাত করতে থাকি তবে আমাদের ধ্বংস নিশ্চিত।
বিবাহঃ
মনুস্মৃতি ৯/ ৮৯:
কামমামরণাত্তিষ্ঠোদ্ গৃহে কন্যর্ত্তু মত্যপি।
ন চৈবৈনাং প্রযচ্ছেত্তু গুণহীনায় কর্হিচিৎ।।
অর্থঃ ঋতুমতি হয়েও কন্যা যাবজ্জীবন গৃহে থাকিবে, সে-ও বরং ভালো, তথাপি কন্যাকে বিদ্যাগুণরহিত পুরুষকে কদাচ দান করিবে না।
মনুস্মৃতি ৯/৯০-৯১:
ত্রীণি বর্ষাণ্যুদীক্ষেত কুমার্য্যৃতুমতী সতী।
উদ্ধান্তু কালাদেতস্মাদ্বিন্দেত সদৃশং পতিম্।।৯০
অদীয়মানা ভর্ত্তারমধিগচ্ছেদ্ যদি স্বয়ম্।
নৈনঃ কিঞ্চিদবাপ্নোতি ন চ যং সাধিগচ্ছতি।।৯১
অর্থঃ কন্যা ঋতুমতী হইলে ৩ বছর পর সে বিবাহযোগ্য হয়। তারপর তাহাকে তাহার নিজের জন্য উপযুক্ত পতি নির্বাচন করিতে দিবে। ৯০
পিত্রাদি কর্তৃক বিবাহ প্রদত্ত না হইলে কন্যা যদি যথাকালে স্বয়ং কোনো পুরুষকে পতিরূপে বরণ করে, তাহলে কন্যার কিছুমাত্র পাপ হয় না। ৯১
প্রচীন কালে ভারতবর্ষে স্বয়ম্বর প্রথা প্রচলিত ছিলো। মেয়েরা তাদের নিজের পতি নিজে পছন্দ করতো। মনুর মতে, মা-বাবা মেয়ের জন্য ছেলে পছন্দ করতে পারে তবে মেয়ের উপর চাপিয়ে দিতে পারেনা। এমনকি মা-বাবা যদি উপযুক্ত পাত্র খুজেও পায় তবুও কন্যাকে স্বয়ম্বরে পতিকে নির্বাচনের সুযোগ দিতে হবে।
সম্পত্তিতে নারীর অধিকারঃ
মনুস্মৃতি ৯/১৩০-৩১:
যথৈবাত্মা তথা পুত্রঃ পুত্রেণ দুহিতা সমা।
তস্যামাত্মনি তিষ্ঠান্ত্যাং কথমন্যো ধনং হরেৎ।।১৩০
মাতুস্ত যৌতুকং যৎ স্যাৎ কুমারীভাগ এব সঃ।
দৌহিত্র এব চ হরেদপুত্রস্যাখিলং ধনম্।। ১৩১
অর্থঃ পুত্র যেমন আত্মার সদৃশ, কন্যাও তেমনি। সুতরাং (এই আত্মাস্বরূপ) পুত্র কন্যা ব্যাতিত অন্য কেউ ঐ ধন লাভ করতে পারে না।১৩০
মাতার সম্পদ কুমারী কন্যার প্রাপ্ত এবং অপুত্রক মাতামহের সমস্ত ধন দৌহিত্রের প্রাপ্ত।১৩১
অর্থৎ, দেখুন! পিতার সম্পত্তিতে কন্যার অধিকার পুত্রের সমান, কিন্তু মায়ের সম্পত্তি কেবল মেয়েই পাবে।
মহর্ষি মনু মেয়েদের জন্য এই বিশেষ অধিকার দিয়েছেন যেন কোনো মেয়েদের কারো অনুগ্রহের দরকার না হয়। তিনি মেয়েদের স্বামিনী বানাতে চেয়েছেন, কারো উপর নির্ভরশীল নয়। কারণ একটি সুখী-সমৃদ্ধ সমাজের ভিত্তি নারীর আত্মসম্মন এবং তাদের প্রসন্নতার উপর নির্ভর করে।
মনুস্মৃতি ৯/২১১-২১৩:
শেষাং জ্যেষ্ঠঃ কনিষ্ঠো বা হীয়েতাংশপ্রদানতঃ।
ম্রিয়েতান্যতরো বাপি তস্য ভাগো ন লুপ্যতে।।২১১
সৌদর্ষ্যা বিভজেরংস্তং সমেত্য সহিতাঃ সমম্।
ভ্রাতরো যে চ সংসৃষ্টা ভগিন্যশ্চ সনাভয়ঃ।।২১২
যো জ্যোষ্ঠো বিনিকুর্বীত লোভাদ্ ভ্রাতৃন্ যবীয়সঃ।
সোঽজোষ্ঠঃ স্যাদভাগশ্চ নিয়ন্তব্যশ্চ রাজভিঃ।।২১৩
অর্থঃ বিভাগ কালে জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ যে ভ্রাতা সন্ন্যাস গ্রহণ দ্বারা বা মরণহেতু স্বীয় অংশ হইতে হীন হইবে, উহার অংশ (তো আর) লুপ্ত হইবে না। সহোদর ভ্রাতারা একত্র হইয়া ঐ অংশ ভাগ করিয়া লইবে। সংসৃষ্ট ভ্রাতারা এবং সহোদরা ভগিনীরা ঐ অংশ হইতে সমান ভাগ পাবে। জ্যেষ্ঠ যদি লোভ বসত তাদের বঞ্চনা করে, তহলে সে জ্যেষ্ঠের মর্যাদা যোগ্য নয়; সে তার অংশ ও পাওয়ার যোগ্য নয়, পরন্তু রাজদণ্ড পাওয়ার যোগ্য।
নারীদের সুরক্ষা অধিক সুরক্ষিত করার জন্য মহর্ষি মনু নারীদেরকে নিজে দখলে সম্পত্তি নিতে বলেছেন, এমনকি যদি কেউ সে ধন হরণ করে, তার জন্য কঠিন শাস্তির বিধান রেখেছেন!
মনুস্মৃতিঃ৮/২৮-২৯:
বশাঽপুত্রাসু চৈবং স্যাদ্রক্ষণং নিষ্কুলাসু চ।
পতিব্রতাসু চ স্ত্রীষু বিধবাস্বাতুরাসু চ।। ২৮
জীবন্তীনাস্তু তাসাং যে তদ্ধরেয়ুঃ স্ববান্ধবাঃ।
তাঞ্ছিষ্যাচ্চৌরদণ্ডেন ধার্ম্মিকঃ পৃথিবীপতিঃ।।২৯
অর্থঃ বন্ধ্যা, নিঃসন্তান, যার পরিবার লুপ্ত হয়েছে, সাদ্ধী কিন্তু বিধবা ও রোগিনী - এরূপ নারীদের ধনের রক্ষা রাজা করবে।২৮
তারা জীবিত থাকিতেই যে সব আত্মীয় তাদের সম্পত্তি দখল করবে একজন ধার্মিক রাজা তাদের চোরের ন্যায় শাস্তি দেবেন।২৯
পণ নিষিদ্ধঃ
মনুস্মৃতি ৩/৫২:
স্ত্রীধনানি তু যে মোহাদুপজীবন্তি বান্ধবাঃ।
নারীযানানি বস্ত্রাং বা তে পাপা যান্ত্যধোগতিম্।।
অর্থঃ পতি-পিতৃ প্রভিতি যে বান্ধবেরা মোহবশতঃ স্ত্রীধন দ্বারা উপজীবিকা করে, স্ত্রীদিগের দাসী, অশ্বাদি যান অথবা বস্ত্র ব্যবহার করে, তাহারা পাপকারী নরক প্রাপ্ত হয়।
মহর্ষি মনুর মত এই যে, স্ত্রীর পিতৃপক্ষ হতে প্রাপ্ত অথবা স্ত্রীর নিজে উপার্জিত কোনো সম্পদ বরপক্ষ ভোগ করতে পারবে না। একইভাবে, পিতৃপক্ষও কন্যার উপার্জিত সম্পদ বা পতিপক্ষ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ ভোগ করতে পারবে না।
যৌতুক শব্দের প্রকৃত অর্থঃ বর্তমানে যৌতুক বলতে কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে বিবাহের সময় যে অর্থ-সম্পদ প্রদান করে তাকে বোঝায়। কিন্তু মনুসংহিতা বা তৎকালে যৌতুক বলতে স্ত্রীর নিজ অধিকার ক্রমে প্রাপ্ত সম্পত্তিকে বোঝানো হতো। যা পিতৃপক্ষ বা বরপক্ষ যে কোনো পক্ষ হতে প্রাপ্ত হতে পারে কিন্তু ভোগে অথবা দানের অধিকার থাকবে শুধু স্ত্রীর।
নারী নির্যাতনের কঠোর শাস্তিঃ
মনুস্মৃতি ৯/৩২৩:
পুরুষাণাং কুলীনানাং নারীণাঞ্চ বিশেষতঃ।
মুখ্যানাঞ্চৈব রত্নানাং হরণে বধমর্হতি।।
অর্থঃ উত্তমকুলোদ্ভব পুরুষেরা স্ত্রীলোক এবং শ্রেষ্ঠ রত্ন অপহরণ করলে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত হইবেন।
মনুস্মৃতি ৯/২৩২:
কুটশাসনকর্ত্তিৃংশ্চ প্রকৃতীনাঞ্চ দূষকান্।
স্ত্রীবালব্রহ্মণঘ্নাংশ্চ হন্যাদ্ বিট্-সেবিনস্তথা।।
অর্থঃ মিথ্যা রাজাজ্ঞাপত্র লেখক, প্রকৃতিবর্গে ভেদকারক, স্ত্রী, বালক ও ব্রাহ্মণহন্তা এবং শত্রুসেবীকে রাজা বধ করিবেন।
মনুস্মৃতি ৮/৩৫২:
পরদারাভিমর্ষেষু প্রবৃত্তান্ নৃ ন্ মহীপতিঃ।
উদ্বেজনকরৈর্দ ণ্ডৈশ্চিহ্নয়িত্বা প্রবাসয়েৎ।।
অর্থঃ রাজা পরস্ত্রী সম্ভোগে প্রবৃত্ত মনুষ্যদিগকে নানাপ্রকার উদ্বেগজনক নাসা-ওষ্ঠ-কর্ত্তনাদিরূপ দণ্ড দ্বারা চিহ্নিত করিয়া দেশ হইতে বিহিষ্কৃত করিবেন।
মনুস্মৃতি ৮/২৭৫:
মাতরং পিতরং জায়াং ভ্রাতরং তনয়ং গুরুম্।
আক্ষারয়চ্ছতাং দাপ্যঃ পন্থানঞ্চাদদদ্ গুরোঃ।।
অর্থঃ মাতা, পিতা, পত্নী, ভ্রাতা, পুত্র অথবা গুরু ইহাদদিগকে যে গালি দেয় ও গুরুকে পথ ছাড়িয়া না দেয় ইহাদের একশত পণ দণ্ড হইবে।
মনুস্মৃতি ৮/৩৮৯:
ন মাতা ন পিতা ন স্ত্রী ন পুত্রস্ত্যগমর্হতি।
ত্যজন্নপতিতানেতান্ রাজ্ঞা দণ্ড্যঃ শতানি ষট্।।
অর্থঃ মাতা, পিতা, স্ত্রী, পুত্র ইহারা ত্যাগার্হ নহেন; ইহাদের পাতিত্য না থাকিলে যে ব্যক্তি ইহাদিগকে ত্যাগ করে, রাজা তাহাকে ছয়শত পণ দণ্ড করিবেন। (পাতিত্য বলতে কেনো অপরাধের কারণে ত্যাগের যোগ্য বোঝানো হয়েছে)
নারীর অগ্রাধিকারঃ
"লেডিস ফাস্ট" - তত্বের প্রবক্তা মহর্ষি মনুই!
মনুস্মৃতি ২/১৩৮:
চক্রিণো দশমীস্থস্য রোগিণো ভারিণঃ স্ত্রিয়াঃ।
স্নাতকস্য চ রাজ্ঞশ্চ পন্থা দেয়ো বরস্য চ।।
অর্থঃ চক্রযুক্ত গাড়িতে আরূঢ় ব্যক্তি, অতিবৃদ্ধ, আতুর, ভারবাহক, স্ত্রীলোক, গুরুগৃহ হইতে প্রত্যাবৃত্ত ব্রাহ্মণ, রাজা ও বিবাহার্থী বর ইহাদিগকে যাইবার জন্য অগ্রে পথ ছাড়িয়া দিবে।
মনুস্মৃতি ৩/১১৪:
সুবাসিনীঃ কুমারাংশ্চ রোগিণো গর্ভিণীস্তথা।
অতিথিভ্যোঽগ্র এবৈতান্ ভোজয়েদবিচারয়ন্।।
অর্থঃ নববিবাহিতা স্ত্রী, পুত্রবধু বা দুহিতাপ্রভৃতিকে, বালকদিগকে, রোগীদিগকে এবং গর্ভবতীদিগকে কোন বিচার না করিয়া অতিথির অগ্রেই ভোজন করাইবে।
উপরোক্ত শ্লোকগুলি থেকে এ সত্যই প্রতীয়মান হয় যে, স্বার্থলোভী কিছু পণ্ডিত তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য মনুস্মৃতির কিছু শ্লোক বিকৃত করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এই প্রক্ষিপ্ত শ্লোকগুলিই বর্তমান সনাতন বিরোধীদের হাতিয়ার।
তা না হলে নারীদের প্রতি এমন উদার নীতির মনুস্মৃতিতে নারীর প্রতি অবমাননাকর কিছু শ্লোক কিভাবে স্থান পেতো?
আসুন মহর্ষি মনুর এই সুন্দর শিক্ষা অনুসরণ করে সুখী-সমৃদ্ধ জাতি গঠন করি এবং তার এই শিক্ষা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিই।
।।ॐ।।