• সর্বশেষঃ

    এই রাধা আসিলেন কোথা হইতে? - পর্ব ২


    সাহিত্য ও দর্শনের রাধাতে সাধনা জগতের বিপর্যয়ঃ
    অতি সূক্ষ্ম অতি উচ্চস্তরীয় বৈষ্ণব সাহিত্য ও ভাববাদী দর্শন তত্ত্বগুলিতে শক্তিরূপিনী যে রাধা-তত্ত্ব পাই তাকে আমরা মহা প্রকৃতির প্রকাশ রূপে কল্পনা করতে পারি মাত্র। কেবল সেই অর্থে তাকে আমরা বিশেষ একটি তত্ত্ব রূপে জানতে পারি । বিদ্যাপতি-জয়দেব-বড়ু চন্ডীদাস-দ্বিজ চন্ডীদাস-গোবিন্দদাস-জ্ঞানদাস-বলরাম দাস প্রভৃতি প্রতিভাধর কবিদের অসাধারণ অনুপম রস বর্ণনায় কল্পনাশ্রিত স্বতন্ত্র পৌরাণিক চরিত্র রূপে রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমলীলার বিষয়কে সাহিত্য রসের দৃষ্টিতে আমরা অকুণ্ঠ প্রসংশাও করতে পারি। সাহিত্য গুণের বিচারের ভক্তি রসাশ্রিত বৈষ্ণব পদাবলী-সাহিত্য বিশ্বে অতুলনীয় ও অদ্বিতীয়। বিশ্বের অন্য কোন সাহিত্যে এ ধরণের সূক্ষ্ম রসাশ্রিত সাহিত্য রচনা হয়েছে বলে লেখকের জানা নাই। এই সাহিত্য গুণের স্বীকৃতি জানাতে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা নাই। কিন্তু কোন ভাবেই, কোন অর্থেই, কোন বেপরোয়া দুঃসাহসেই সাহিত্যের ও কাব্যের কল্পিত কৃষ্ণ ও কল্পিত মানস-কন্যা লীলারঙ্গিনী রাধাকে এবং দর্শনের সেই শক্তি স্বরূপিনী ভাববাদী দার্শনিক তত্ত্ব-নির্ভর হ্লাদিনী-শক্তিরূপী কাল্পনিক রাধাকে ধর্ম-সাধনার ধ্যানাসনে, সহস্রার-চক্রশীর্ষে সাধ্য-র’ ‘সর্বতত্ত্বসার’ মর্যাদায় উপবিষ্ট করাতে পারি না। করলে সেটা হবে ধর্ম জগতে বিপর্যয়, সাধক-সাধিকাদের ধ্যান-প্রক্রিয়ায় চরমতম সংকট। কারণ সেটা এক অনন্ত অদ্বিতীয় কৃষ্ণ-রূপী পরমব্রহ্ম সত্তারই। একমাত্র অবস্থান-তীর্থ। সেখানে অন্য কল্পিত দ্বৈত-সত্তার স্থান নেই। অনন্তত্ত্বে দ্বিত্বের অবকাশও নেই। রাজাধিরাজ যোগের সেই অনন্ত সিংহাসনে রাজার রাজা পরমব্রহ্ম কৃষ্ণই সেখানে একম অদ্বিতীয়ম অনন্ত তত্ত্ব। পরব্রহ্ম কৃষ্ণই সেখানে উপবিষ্ট হতে পারেন। বৈষ্ণব দর্শন ও সাহিত্যের কল্পনাসৃষ্ট রাধা ও কৃষ্ণের সেই আসনে স্থান নাই।

    সমাজ-মানসে বিপর্যয়ঃ
    শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং হলেন মহাসম্ভূতির আধারে পূর্ণব্রহ্ম। তন্ত্রের ভাষায় তিনি তারক ব্রহ্ম ! পাঞ্চভৌতিক দেহ ধারণ করে এই পৃথিবীতে সর্বজীবের বিমুক্তির পথ দেখাতে, দুষ্টের দমন করতে, শিষ্টের পালন ও ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ধরাধারে মহাসম্ভত রূপে এসেছিলেন। সেই ঐতিহাসিক কৃষ্ণ তাই আমাদের ধ্যানেরও ঘনীভূত চৈতন্য-সত্তা। তিনি সাধকের তৈলধারাবৎ মানস সাধনায় অসাম অনন্ত জ্যোতির্ময় শক্তিময় আনন্দময়, জ্ঞানময় ব্রহ্মরূপ পরিগ্রহ করেন। সেই ব্ৰহ্মস্মি কৃষ্ণের ধ্যানে সাধক-সাধিকারা ওজঃ বীৰ্য ভক্তি তেজ জ্ঞান বৈরাগ্য কান্তাপ্রেমের ঐশ্বর্য্যে ভরপূর হয়ে ওঠেন। সেই অতুলন অনিন্দ্যসুন্দর জ্যোতিপুরুষ শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে কবিদের কল্পিত নীলারসরঙ্গে ব্যস্ত কৃষ্ণ-রাধাকে, ভাববাদী দার্শনিকদের কল্পিত শুষ্ক তত্ত্বের ঘাস বিচালি মিশ্রণে গড়া কৃষ্ণ ও রাধাকে অবিচ্ছেদ্য করে তুললে গ্রামে-গঞ্জে সাধারণ কোটি কোটি মানুষের মানসস্তরে আধ্যাত্মিক সাধনার সর্বনাশ ও ভাব-বিপর্যয় ঘটতে বাধ্য। দুঃখের সঙ্গে বেদনাহত চিত্তে আজ তাই বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আমাদের দুই বাংলারই বৃহত্তর সনাতন সমাজ-মানসে এ কারণে মানস-আধ্যাত্মিক সাধনা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বড় ধরণের সর্বনাশ ও বিপর্যয় ঘটে গেছে। রাধা-তত্ত্বের বৈষ্ণবীয় দার্শনিক ও সাহিত্যিক ভাব-মাধুর্য, রাধা-তত্ত্বের 'রাধাভাবদ্যুতিসুবলিত’ সুউচ্চ ভক্তি সম্প্রদ্য, রাধা-তত্ত্বের প্রতি অঙ্গ লাগি কাদে প্রতি অঙ্গ মোর’ কৃষ্ণ-প্রেমোন্মত্ততা কেবল ক্ষণজন্মা দিব্যপ্রেমস্বরূপ। কামগন্ধহীন মহাপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেবের মত ভক্তশ্রেষ্ঠ ব্যষ্টিত্বই সঠিকভাবে আপন সত্তার আত্মস্থ করতে পারেন। সাধারণ কোটি কোটি উদর-উপস্থজীবী সংসারী নর-নারী যারা শহরে-গ্রামে-গঞ্জে দাম্পত্য জীবনের সম্ভোগে হাবুডুবু খাওয়া সাধারণ জীবমাত্র, তাদের মানস-পটে রাধা-কৃষ্ণের বাধনহারা রাসলীলা, রাধা-কৃষ্ণের নৈশ অভিসার লীলা, অবৈধ পরকীয়া প্রেমে ইত্যাদি ব্যাপার গুলো রতি-সুখেরই উদ্রেক করবে। ব্রহ্মভাব কান্তাপ্রেম অথবা বৈষ্ণবীয় দর্শনের হ্লাদিনী তত্ত্বের’সু-উচ্চ ভাব-রস সেখানে মধুক্ষরণ ঘটবে। না, ঘটতে পারে না। বরং তাদের কামময় কোষ ও মূল্যধার চক্রকেহ উজ্জীবিত করবে । কথাগুলি অপ্রিয় হলেও গণ-মনস্তত্ত্বের বিচারে কঠিন রূঢ় বাস্তব সত্য।


    আমাদের আজ বুঝতে হবেঃ
    আমাদের কাজ বুঝতে হবে যে সাহিত্য-জগতের ও ভাববাদী দর্শণ-জগতের কাল্পনিক রাধা তত্ত্বগুলি এক জিনিস আর তাকে ধর্ম-সাধনা ও আধ্যাত্মিকতার গুরুত্বপূর্ণ স্তরে সাধ্য-তত্ত্ব রুপে প্রতিষ্ঠিত করার ধৃষ্টাতা দেখান আরেক জিনিস। বৈষ্ণবীয় সাহিত্য ও দর্শনের রাধা-তত্ত্বকে আমাদের ধর্ম-সাধনা ও আধ্যাত্ম-বিজ্ঞানের জগতে চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে আমদানি করে সাধারণ মানুষের ধর্ম চেতনার জগতে এক বড় ধরনের বিপর্যয় (ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক) সংঘটিত করা হয়েছে। দুই বাংলার বৃহত্তর সনাতন জনগোষ্ঠীর অনেকেই আজ তাই রাধা-কৃষ্ণ প্রেমলীলার অনুসরণে গ্রাম-গঞ্জে যে ধরণের ধর্মমতের আচার-অনুষ্ঠান, কুব্যবহার ও অশিষ্টাচার প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে তার ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া আমাদের সামূহিক সমাজ-মানসেও ইতোমধ্যে দেখা দিয়েছে। স্বভাবতঃই ধর্মচেতনার ক্ষেত্রকেও সেই কু-প্রভাবের কালো মেঘ আচ্ছন্ন করে রেখেছে।


    ধর্ম-সাধনার ক্ষেত্রে ক্ষতিটা সবচেয়ে বেশীঃ
    * দুই বঙ্গেরই সনাতন সম্প্রদায়ের অনুগামীদের বড় অংশ আজ হীনবীর্যতা, ভীরুতা, কাপুরুষতা, প্রতিবাদহীনতা, সগ্রামবিমুখতা প্রভৃতি মানসিক ক্লীবতায় আক্রান্ত।
    * জীবন সংগ্রামের সর্বক্ষেত্রে-সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাষ্ট্রনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে, আজ তারা পশ্চাদমুখী, পদানত, প্রতিবাদহীন, অধস্তন, ভীরু, দ্রুত ক্ষয়িষ্ণু জনগোষ্ঠী মাত্র।
    *ধর্মক্ষেত্রে ক্ষতিটা হয়েছে সবচেয়ে বেশী আমাদের ধ্যানের ধ্যেয় পূব্রহ্ম শ্রীকৃষ্ণকে যদি সাহিত্য-নাটক-কাব্য-পালাগানের খল নায়কের মত পরকীয়া প্রেমাসক্ত কামুক লম্পট করে তোলা হয়, তাকে যদি নারীমাংসলোলুপি নারীসঙ্গাভিলাষী মর্ষকামী একজন প্রেমিক রূপে গণমানষ স্তরে বার বার উপস্থাপিত করা হয়, সেই সঙ্গে তাকে যদি সর্বঘটে মন্দিরে, প্রতিমায়, ছবিতে, বিগ্রহে প্রতিনিয়ত কল্পিত এক রূপসী রাধারাণীর যৌবনমদমত্ত স্ফীতবক্ষালিঙ্গনাবিষ্ট পুরুষ প্রেমিকের যুগল-মূর্তিতে চরিত্রায়িত করা হয় তবে সেই বিকৃত অবক্ষয়িত স্থলিত কৃষ্ণরূপী ধ্যেয়কে বিগ্রহের (রাধাকৃষ্ণের) জন্য প্রেমভাব সাধারণ রিপু পাশবদ্ধ মানুষের মনে আদৌ হঠাৎ করে জাগানো সম্ভব নয়। সেটা বিবেচনা না করেই বৈষ্ণব সাহিত্যের জৈব আদিরসাত্মক ভাব-আঙ্গিকে গড়া রাধাকৃষ্ণের রাসলীলা তত্ত্ব, পরকীয়াতত্ত্ব, অভিসার-তত্ত্বগুলি ধর্মমতের আসরগুলিতে তরল মেজাজে প্রচার করতে গিয়ে মহাপ্রভুর পরবর্তী বৈষ্ণর ধর্মপ্রচারক বৈষ্টব-বৈষ্টবীরা ধর্ম-জীবনে এই চরম বিপর্যয় ঘটিয়েছেন।



    শুধু কি বৈষ্টব-বৈষ্টবীরাই দায়ী ?
    বঙ্গীয় সনাতন সমাজে এই বিপর্যয়ের জন্য ইতিহাসের দৃষ্টিতে অবশ্য এককভাবে শুধু বৈষ্ণব-পন্থী আচাৰ্য্যদের ষোলআনা দায়ী করা যায় না। তাদের দ্বারা প্রচারিত রাধা-কৃষ্ণ তত্ত্বের অবমূল্যায়ণ ও বিকৃতিকরণই এই বিপর্যয়ের একমাত্র কারণ নয়। প্রাচীন এই বঙ্গীয় সনাতন সমাজ মানসের। বিপর্যয়কে বৃহত্তর ভারতীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে যে আরও কারণগুলি আমাদের নিরপেক্ষ বিশ্লেষণে ধরা পড়ে সেগুলি হল ।
    (১) বৈদিক কর্মকাণ্ডের ধারাবাহিকতায় বাহিত সর্বনাশা জাতপাতবাদ’ ও ‘বর্ণবৈষম্যবাদ’ (Casteism)
    (২) বৌদ্ধ ধর্ম মতের প্রচারিত সর্বাত্মক দুঃখবাদ' (Pessimism)
    (৩) জৈন ধর্মমতের ভ্রান্ত অহিংসবাদ’ (Deoctrine of NonViolence)
    (৪) শঙ্করাচার্য্যের সনাতন হিন্দু ধর্মের অবাস্তব ‘মায়াবাদ (Doctrine of illusisonism)
    এই চার তত্বের বিমিশ্র প্রতিক্রিয়া ভারতীয় তথা গৌড়ীয় সনাতন সমাজে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যে এক ধরনের নেতিবাচক বন্ধ্যা পঙ্গু মনস্তত্ত্বের (Passive Psychology) জন্ম দিয়েছিল সেই বন্ধ্যা মনস্তত্ত্বকে পরবর্তী কয়েক শতাব্দী কালে বঙ্গীয় বৈষ্ণব-ধর্মমতের প্রচারকরা কল্পিত রাধা-কৃষ্ণের দেহাতীত প্রেমের নামে শৃঙ্গাররসাশ্রিত দেহগত প্রেমের লীলা খেলা যথেচ্ছভাবে প্রচার করে আরও বেশী হীনবীৰ্য্য, অক্ষম ও মেরুদন্ডহীন। করে তুলেছেন। ফলে আজ সনাতন গৌড়ীয় সমাজ মানসে নেমে এসেছে। বিপর্যয়, অবক্ষয়, কুসংস্কারের ধূম্রজাল, ভাবজড়তার অচলায়তন এবং কাপুরুষতা।