• সর্বশেষঃ

    এই রাধা আসিলেন কোথা হইতে? - পর্ব ১


    (বিদ্রঃ এই আর্টিকেলটির ১ম ২ পর্ব "এই রাধা আসিলেন কোথা হইতে?" -  নামক পুস্তক হতে সঙ্কলিত)

    বাংলায়-এপার বাংলা ওপার বাংলায় দুই বাংলার বৈষ্ণবীয় সনাতন জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে রাধার যুগল মিলন প্রতিমার ধ্যান-ধারণা গভীর ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে।
    এই রাধা কে? তিনি কী ভাববাদী বৈষ্ণবীয় দর্শনের কোন দার্শনিক তত্ত্ব? তিনি কী বৈষ্ণব সাহিত্য সৃষ্ট শ্রীকৃষ্ণের কোন মনবনবিহারিণী প্রাণবল্লভী? অর্থাৎ বৈষ্ণবীয় কবিদের অসাধারণ সর্জন-প্রতিভা সংজাত কাল্পনিক কোন রূপসী প্রতীকি নারী সত্তা? তিনি কি কোন এক আয়ন ঘোষের স্ত্রী? তিনি আসলে কি?

    ইতিহাসের আলোয় রাধা-তত্ত্বঃ
    ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ ও কবি জয়দেবের কাব্যগ্রন্থ ছাড়া কোন প্রাচীন গ্রন্থেই কিন্তু রাধা নাই। মূল মহাভারতে রাধা নাই। চার বেদে রাধা নামক কোন রমনীর নামগন্ধ নাই। ১০৮টি উপনিষদের সুবিশাল জ্ঞান বিজ্ঞানের দিগন্তে রাধা নামক কোন তত্ত্ব-জিজ্ঞাসু বা কৃষ্ণ-প্রেয়সী রমনীর পদচারণ নাই। মূল রামায়ণেরও রাধা অনুপস্থিত। শ্রীকৃষ্ণের মুখনিসৃত অমর গ্রন্থ গীতার ১৮টি অধ্যায়ের শত শত শ্লোকের হাজার হাজার শব্দ রাশির মধ্যে কোথাও রাধারাণীর উল্লেখ নাই। এমন কি বৈষ্ণব-ধর্মীয় মানুষজনের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ মূল ভাগবতের রাসপঞ্চাধ্যায়ের ভিতরেও শ্রীকৃষ্ণের শক্তিরূপিনী কোন রাধা নামের সুস্পষ্ট উল্লেখ নাই। ইতিহাসের আলোয় রাধাকে আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।

    তবে এ রাধা এলেন কোথা থেকে? শুধু তিনি এলেনই না, তিনি আমাদের পরমপূজ্য ও ধ্যানাসনের ধ্যান-বিগ্রহ শ্রীকৃষ্ণের অবিভাবী লীলাসঙ্গিনী হলেন কি ভাবে? শুধু কি লীলাসঙ্গিনী হয়েছেন তিনি? চৈতন্যোত্তর ও চৈতন্যপূর্ব বৈষ্ণবীয় কবি ও পদকর্তাদের কাব্যে গল্পে। পালাগানে রাধাকে বাংলার জনমানসে এমন ভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে যে কোথাও কোথাও রাধাই হয়ে উঠেছেন প্রধান শক্তিরূপিনী মুখ্য সত্তা। কৃষ্ণ হলেন তার গৌণ রাধা-নির্ভর এক পুরুষ রূপী পার্শ্বচরিত্র মাত্র।

    বঙ্কিমচন্দ্রের মতে রাধা তত্ত্বঃ
    মহাভারত, গীতা, ভাগবত, সমগ্র বৈষ্ণব রস সাহিত্য, বৈষ্ণব দর্শন ও পুরাণগুলি গভীরভাবে গবেষণা করে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় শ্রীকৃষ্ণের ঐতিহাসিকতা ও মহত্ত্ব প্রমাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন। তার সেই জ্ঞান-গভীর যুক্তিবিশ্লেষণধর্মী ধার্মিক চেতনা প্রেষিত গবেষণার দ্বারা তিনি শ্রীকৃষ্ণেকে বিশ্বের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষদের মধ্যে অন্যতম। একজন রূপে চিহ্নিত করেছেন। শ্রীকৃষ্ণের মহিমা ও ঘটনাবহুল জীবনের নানা কাহিনী ও তত্ত্বগুলি নিয়ে গবেষণা করতে করতে তিনি রাধা তত্ত্ব নিয়েও ব্যাপক গবেষণা শুরু করেন। তিনি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন। কি ভাবে কোন উৎস থেকে শ্রী রাধার আগমন ঘটেছে। অনেক অনুসন্ধানের পর তিনি এ প্রসঙ্গে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ "কৃষ্ণচরিত্র"-তে যে সুচিন্তিত অভিমত প্রকাশ করেছেন সেটি আমরা নিম্নে উপস্থাপনা করছি।
    ..... ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আর জয়দেবের কাব্যে ভিন্ন কোন প্রাচীন গ্রন্থে রাধা নাই।
    ভাগবতের এই রাসপঞ্চাধ্যায়ের মধ্যে 'রাধা' নাম কোথাও পাওয়া যায় না। বৈষ্ণবাচাৰ্যদিগের অস্থিমজ্জার ভিতর রাধা নাম প্রবিষ্ট। তাহারা টীকা টিপ্পনীর ভিতর পুনঃপুনঃ রাধা প্রসঙ্গ উত্থাপিত করিয়াছেন কিন্তু মূলে কোথাও রাধার নাম নাই । গোপীদিগের অনুরাগাধিক্যজনিত ঈষার প্রমাণ স্বরূপ কবি লিখিয়াছেন যে তাহারা পদচিহ্ন দেখিয়া অনুমান করিয়াছিল যে, কোন এক গোপীকে লইয়া কৃষ্ণ বিজনে প্রবেশ করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহাও গোপীদিগের ঈর্ষাজনিত ভ্রম মাত্র। শ্রী কৃষ্ণ অন্তর্হিত হইলেন এই কথাই আছে, কাহাকে লইয়া অন্তর্হিত হইলেন এমন কথা নাই এবং রাধার নামগন্ধও নাই।
    রাসপঞ্চাধ্যায়ে কেন, সমস্ত ভাগবতে কোথাও রাধার নাম নাই। ভাগবতে কেন, বিষ্ণু পুরাণে, হরিবংশে বা মহাভারতে কোথাও রাধার নাম নাই। অথচ এখনকার কৃষ্ণ উপাসনার প্রধান অঙ্গ রাধা। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণ নাম নাই। রাধা ভিন্ন এখন কৃষ্ণের মন্দির নাই বা মূর্তি নাই। বৈষ্ণবদিগের অনেক রচনায় কৃষ্ণের অপেক্ষাও রাধা প্রাধান্য লাভ করিয়াছেন, তবে এ রাধা’ আসিলেন কোথা হইতে? “ঋষি বঙ্কিমের রাধা সম্বন্ধীয় এ প্রশ্ন খুবই সঙ্গত।


    অন্যান্য মনীষীদের দৃষ্টিতে রাধা তত্ত্ব :
    ঋষি ও সাহিত্য সম্রাট বঙ্গিমচন্দ্র যে প্রশ্ন তুলেছেন, আমরাও সেই প্রশ্নটি নিয়েই এখানে আলোচনা করছি। শুধু আমরা কেন গত কয়েক শতাব্দী ধরে বাংলার সনাতন জন সমাজের জ্ঞানী গুণী ধর্ম প্রাণ শ্রদ্ধেয় মানুষেরাও 'রাধা'-র ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের স্ব-স্ব অভিমত দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বৈষ্ণব পদাবলী পরিচয়' গ্রন্থের লেখক অধ্যাপক শান্তিরঞ্জন ভৌমিক ‘রাধা তত্ত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে কয়েকজন সারস্বত ব্যষ্টির মতামতও লিখেছেন। সেই মতামতের উদ্ধৃতিও নিম্নে দেওয়া হল।
    “রাধা ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মত অর্বাচীন। পুরাণেই তার প্রথম আবির্ভাব লক্ষ্য করা যায়।”

    ডঃ শশীভূষণ দাশগুপ্তের মতে, "সাহিত্য সৃষ্টির খাতিরে সাহিত্যকে অবলম্বন করে বৈষ্ণব রস সাহিত্যে রাধার আবির্ভাব ঘটেছে এবং উন রসের মাধ্যমে শেষ পর্যন্ত তাকে বৈষ্ণব ধমে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।"

    ডাঃ নীহার রঞ্জন রায়ের মতে, "বাংলার বৈষ্ণব ধমের ওপর শাক্ত ধর্মের প্রভাব পড়বার ফলে কৃষ্ণের শক্তিরূপিনী রাধার কল্পনা করা হয়েছে।
    কৃষ্ণের তুলনায় রাধার আবির্ভাব যে অত্যন্ত অর্বাচীন এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনে তাকে যে নতুন করে আবিষ্কার করা হয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই”



    রাধা-তত্ত্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্তঃ
    অর্থাৎ রাধা মূল ভাগবতে নাই। গীতা-বেদ-বেদান্ত উপনিষদমহাভারত-রামায়ণ-চন্ডী ইত্যাদি কোন প্রধান ধর্মীয় গ্রন্থেও তিনি নাই। উপরের উদ্ধৃত্তিগুলি থেকে আমরা যা যা বুঝি তাতে স্পষ্ট ভাবেই সিদ্ধান্তে পৌছান যায় যে,
    * রাধা কোন ঐতিহাসিক ব্যষ্টিত্ব ছিলেন না।
    * গৌড়ীয় বৈষ্ণব- দার্শনিকরা দার্শনিক তত্ত্ব রূপে (যা মাত্র ৫০০ বৎসরের প্রাচীন) শ্রী কৃষ্ণের লীলা শক্তির যে প্রধান তিন ভাগের (স্বরূপ শক্তি, জীবশক্তি ও মায়া শক্তি) বর্ণনা করেছেন সেই তিন ভাগের মধ্যে যে স্বরূপ শক্তি সেই স্বরূপ-শক্তির আবার যে আরও তিনটি মুখ্য উপভাগ রয়েছে। (অর্থাৎ সৎ, চিৎ ও আনন্দ) সেই উপভাগের মধ্যে আনন্দ তত্ত্বটি বা হ্লাদিনী। তত্ত্বের মানবী রূপ হিসেবে কল্পনা করেছেন রাধাকে। অর্থাৎ রাধা হলেন সম্পূর্ণত গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের এবং গৌড়ীয় দার্শনিকদের আনন্দ বা হ্লাদিনী নামক তত্ত্বের কাল্পনিক মানবিক চরিত্র মাত্র। রাধার কোন ঐতিহাসিকতা বা বাস্তব অস্তিত্ব কোন কালেও ছিল না।

    * কালের বিচারে এই রাধা তত্ত্বটাও খুব অর্বাচীন।

    *রাধাকে সৃষ্টি করা হয়েছিল সাহিত্য রস সৃষ্টির খাতিরে । সেই জন্যে আমরা রাধাকে ব্যাপক ভাবে দেখতে পাই সাহিত্য-জগতে । বৈষ্ণব কাব্যে কবি জয়দেব-কবি চন্ডীদাস-কবি বিদ্যাপতি-কবি জ্ঞান দাস-গোবিন্দদাস- কবি বুলরাম দাস প্রভৃতি কবিদের রচনার ছত্রে ছত্রে রাধা আছেন। নানা ভাব মাধুর্যের লীলা রসে রাধা সদা বিচরণশীল। আবার কোথাও কোথাও অতি স্থল জৈবে দেহ-সর্বস্ব আদিরসের কামোদ্দীপক যৌন রুচি বোধে রাধা চরিত্রের চিত্রায়ণ ঘটেছে। রাধা তাই ভাববাদী গৌড়ীয় বৈষ্ণব-দর্শনের যেমন এক সূক্ষ্ম তত্ত্ব আবার গৌড়ীর বৈষ্ণব সাহিত্যের তেমনি লীলা রসরঙ্গিনী মানসী চরিত্র। কিন্তু কোন ভাবেই রাধা ঐতিহাসিক চরিত্র নয়। কোন সূত্রেই আমরা তার ধর্মীয় শাস্ত্রীয় সমর্থন মূল প্রাচীন ধর্মগ্রন্থগুলিতে খুঁজে পাই না। অতএব রাধা নামক রক্ত মাংসের নারীরূপী কোন মানসী চরিত্র ঐতিহাসিক শ্রীকৃষ্ণের নিষ্কলুষ অনিন্দ্যসুন্দর অনন্যসাধারণ ঐশ্বরীয় জীবনে উপস্থিত ছিল না।