• সর্বশেষঃ

    বেদে গোরক্ষা অথবা গোহত্যা? পর্ব - ৩

    গোঘাতকদের আণবিক বোমা-
    গো হিংসা সমর্থনকারীদের সব থেকে বড় অস্ত্র (১) গোঘ্নহতিথি : এবং (২) গোমধ যজ্ঞ। আমাদের কাছে এটি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, কিভাবে অত্যন্ত চাতুরীর দ্বারা উপরোক্ত প্রয়োগ দুটি মাংসাহারের স্বপক্ষ প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।
    গোঘ্নো অতিথঃ মহামুনি পাণিনির ন্যায় বৈয়াকরণ-এ পৃথিবীতে কেউ প্রতিষ্ঠিত হতে পারেন নি। তার সূত্র হল-

    “দাশগগাগ্নৌ সম্প্রদানে” (অষ্টা ০ ৩-৪-৭৩)
    এর সরল অর্থ হল—“দাশ ও গোঘ্ন’ শব্দ দুটি সম্প্রদানে নিপাতনদ্বারা নিষ্পন্ন করা হয়।
    গোঘ্নকে এই প্রকারে সম্প্রদান কারকে ব্যাখ্যা করা হয়।
    “গৌহণ্যতে তস্মৈ গোঘ্নঃ” এই হণ্যতে শব্দের অর্থ মাংসাহারীরা এভাবে করেন, “হ্যতে হত্যা করা হয়”। “গৌণ্যতে যস্মৈ বা তস্মৈ স গোঘ্নঃ”। এই ব্যাখ্যাতে না আছে কোন ত্রুটি, না আছে মতভেদ। কিন্তু হণ্য শব্দটি কেবল হত্যার জন্যই ব্যবহৃত হয়না। হণ্যতের অর্থ গম্যতে। প্রাপ্যতে রূপেও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ গৌণ্যতে-গাভীকে প্রাপ্ত করানো হয় কিংবা দান করা হয়। সুতরাং কিভাবে?
    এই ধাতুর অর্থ কেবল হত্যা’ নয়, এর অর্থ ‘গতিও হয়। আচার্য পাণিনি ধাতুপাঠে ‘হন্’ ধাতুর পাঠও দিয়েছেন। 
    “হন হিংসাগত্যোঃ”
    অর্থাৎ হ-এর প্রয়োগ দুপ্রকার অর্থে করা হয়—(১) হিংসা এবং (২) গতি৷ গতির অর্থও তিন প্রকারের- “গতেস্রযোহর্থাঃ জ্ঞানং গমনং প্রাপ্তিশ্চ”। জ্ঞান, গমন ও প্রাপ্তি। সুতরাং গৌর্হণ্যের অর্থ গৌর্গম্যতে অথবা গৌঃপ্রাপ্যতে। অতিথির নিকট গাভীকে প্রাপ্ত করানো হয়, অতএব একে সম্প্রদান বলা যায়, বধতো বলা যায় না। আরও একটি বাক্যের বিচার করা যাক- গোঘ্নো অতিথিঃ, এর প্রয়োগ দেখা যায়। যদি হন্যতের অর্থ হত্যা হয়, তাহলে গোহত্যা চণ্ডাল কিংবা অন্যান্য মাংসাহারীদের ক্ষেত্রেও হত্যা করা হবে। কিন্তু গোঘ্নো অতিথির ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়, চণ্ডালাদির নিমিত্ত নয়। প্রসিদ্ধ বৈয়াকরণ কাশিকাকার লিখছেন যে, চণ্ডালাদি গোঘ্ন নয়, গোঘ্নতো অতিথি।
    “গোঘ্নো অতিথিঃ ন তু চণ্ডালাদিঃ”
    অতএব গোঘ্নঃ শব্দের অর্থ হত্যা হবেনা, প্রদান, প্রাপ্ত করানোই হবে। হন্যতে-এর অর্থ বহু স্থানে গম্যতে-প্রপ্যতে হয়। মহাবৈয়াকরণ পাণিনির একটি সূত্র আছে।
    “উপগ্ন আশ্রয়ে”  (অষ্টা0 ৩/৩/৮৫)
    এর উদাহরণ হল—“পর্বতোপগ্নঃ” ব্যাখ্যা-“পৰ্বতেনোপহন্যতে সমীপ্যেন গম্যতে” অর্থাৎ পর্বতের সমীপে যায়। এস্থানে এর অর্থ গমন। হন্ ধাতুর অন্যান্য গত্যর্থক প্রয়োগ আছে। অথর্ববেদে হন্ ধাতুর গত্যর্থক প্রয়োগ নিম্নরূপ-
    “যথাঙ্গবর্ধতাং শেপস্তেন যোষিতমিজ্জহি”
                                                        (অথর্ব ৬-১০১-১) 
    অর্থাৎ হে পুরুষ। তুমি পৌরুষ সম্পন্ন হয়ে আপন পত্নীর নিকট যাও (যোষিতম্+হত্+জহি)। এই জহি হন্ ধাতুরই রূপ এবং সকল ভাষ্যকারগণ এর অর্থ গচ্ছ=যাও এভাবেই বর্ণনা করেছেন। অতএব এর কেবলমাত্র একটি অর্থ হত্যাই নয়।


    গোঘ্ন শব্দের বিচার-
    কোন বেদেই গোঘ্ন শব্দ অতিথি অর্থে প্রয়োগ করা হয়নি, সাহিত্য গ্রন্থেও বোধহয় কোথাও নেই। এটি বিদ্বানগণের অন্বেষণের প্রসঙ্গ যে গোঘ্নোহতিথিঃ- এর প্রয়োগ কোথায় করা হয়েছে? কোন প্রয়োজন সিদ্ধ করার জন্য আচার্য পাণিনি “দাশগোঘ্নৌ সম্প্রদান” সূত্রের দ্বারা ‘নিপাতন’ করেছেন। নিপাতনের অর্থই হল যে, সামান্য ব্যাকরণ থেকে সরে এসে আচাৰ্য অপবাদ রূপে শব্দকে স্বীকার করেন।
    গোঘ্ন শব্দের ব্যাকরণ এবং সাহিত্যের মধ্যে প্রয়োগ সম্মত অর্থ আছে। “গাং হন্তি অসৌ” এই অর্থের প্রয়োগ বহু পাওয়া যায়। কিন্তু সম্প্ৰদান কারকে, অতিথি অর্থে বৈদিক সংহিতায় এবং অন্য ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় না। অবশ্য গোহত্যাকারী অর্থে গোঘ্ন শব্দ বেদে এক আধ স্থানে পাওয়া যায় এবং লৌকিক সাহিত্যেও এর প্রয়োগ দেখা যায়।
    বেদে হত্যাকারী অর্থে গোঘ্ন -ঋগ্বেদে নিম্ন পাঠ পাওয়া যায়-

    “আরে তে গোঘ্নমুত পূরুষঘ্নম্” (ঋগ্বেদ ১/২১৪/১)
    অর্থাৎ যে ‘গোঘ্ন’, গোহত্যাকারী এবং যে পুরুষঘ্ন সে মানব হত্যাকারী, তারা তোমাদের থেকে দূরে থাকুক। প্রয়োগ ও সাহচর্যের দ্বারা এ বিষয়টি এমনভাবে মনের মাঝে ধারণার সৃষ্টি করে যে, বৈদিক বর্ণনায় গোহত্যা মানব হত্যার সমান। 
    রামায়ণের মধ্যেও হত্যারা’ অর্থে গোঘ্ন-
    বাল্মীকি রামায়ণে কিষ্কিন্ধা কাণ্ডের একটি শ্লোকে ‘গোঘ্ন’ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়।
    “গোঘ্ন চৈব সুরাপে চ, চৌরে ভগ্নব্রতে তথা”
                                                          কিষ্কিন্ধ ৩৪/১২ 
    এখানে গোঘ্ন শব্দ ব্যবহারের মাধ্যমে গোহত্যাকারী, সুরাসক্ত, চোর ও ব্ৰতভঙ্গকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। হত্যাকারী অর্থে আরও অনেক শব্দের প্রয়োগ পাওয়া যেতে পারে কিন্তু অতিথি অর্থে গোঘ্ন শব্দের প্রয়োগ কোন বেদ কিংবা লৌকিক সাহিত্যে পাওয়া যায় না।


    ইতিহাসে আতিথ্যের জন্য গোহত্যার কথা নেই-
    বৈদিক এবং লৌকিক সাহিত্যের বিশাল ও সুবিস্তৃত ভাণ্ডার আছে। রামায়ণ, মহাভারত, রঘুবংশ আদি অন্যান্য অনেক উত্তমোত্তম গ্রন্থে হাজারো স্থানে অতিথি সৎকারের বর্ণনা পাওয়া যায়। অথচ কোন অতিথিকে খাওয়ানোর জন্য গোহত্যা করা হয়েছে এমন নিদর্শন কোথাও পাওয়া যায় না। অবশ্য ! ‘উত্তর রামচরিতম্’-এর মধ্যে ভবভূতি পরিহাসাত্মক প্রসঙ্গ অবশ্য উপস্থিত করেছেন। অন্যথা, ঋষিগণ রাজাদের নিকট আসা যাওয়া করতেন। কিন্তু গো হত্যার বর্ণনা তো কোথাও পাওয়া যায়নি, উপরন্তু পাদ্য, অর্ঘ্য ইত্যাদি সামগ্রীর উল্লেখ পাওয়া গেছে।
    বাইবেলের তৌরেতে আব্রাহিম ঈশ্বরের আতিথ্য করার সময় একটি মুলায়ম বাছুরের মাংস এবং রুটির আহার করিয়েছিলেন। এটি খৃষ্টান সংস্কৃতি। কিন্তু ভারতের সহস্ৰ অতিথি সকারের বর্ণনায় কোথাও গোমাংসের বর্ণনা পাওয়া যায় না। এই অনার্য সংস্কারগুলি আর্যগণের মধ্যে প্রচলিত করার চেষ্টা বহুদিন যাবৎ চলে আসছে। কোন কথাকাহিনীকে কোথায় কে কখন ধারণ করে, তার ঠিকানা কে রাখে। রাজা রন্তিদেবের কাহিনীও ঠিক ঐ প্রকার। আফগানিস্থান, বেলুচিস্থান পর্যন্ত আর্যদের প্রগাঢ় সম্বন্ধ তো ছিলই। কিন্তু আরও পশ্চিম আরব, ইউনানী প্রভৃতির সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। এই সকল পশ্চিমী দেশ সাংস্কৃতিক দিক থেকে ততটা পবিত্র ছিলনা। কিন্তু বৈদিক অথবা ভারতীয় সংস্কৃতিতে অতিথি সৎকারের জন্য গোহত্যা কখনও স্বীকৃত হতে পারে না।



    অতিথিগ্বঃ
    অতিথি কতিপয় বিদ্বান ‘অতিথিগ্ব’-এর অর্থ করেন ‘অতিথিগণকে গোমাংস পরিবেশনকারী। এ সকল ব্যক্তিদের বিচারে ‘অতিথিগ্ব’ এক প্রকার সম্মানসূচক উপাধি ছিল। এঁদের মধ্যে ভারতীয় বিদ্যাভবনের প্রতিষ্ঠিত বিদ্বান শ্ৰী কনহৈয়ালাল মাণিলাল মুন্সী হলেন প্রধান। শ্ৰী সায়ণাচার্য
    এবং স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতী এর অর্থ লিখেছেন
    “অতিথীন্ প্রতি সেবাৰ্থং গচ্ছন্” অর্থাৎ সেবা করার জন্য অতিথিগণের নিকট গমন করা। এখানে গোমাংসের কথা কোথা থেকে আসছে? ইউরোপীয় বিদ্বানেরাও অতিথি’ শব্দের অর্থ হিংসা অর্থে করেন নি।
    প্রোফেসর মোনিয়র উইলিয়ম্ অতিথিগ্ব-র অর্থ করেছেন—‘To whom guests should go' যার নিকট অতিথিগণ গমন করেন।
    প্রোফেসর ব্লুমফীল্ড অতিথিগ্ব-র অর্থ করেছেন—‘Presenting cows to guests. অতিথিদের গাভীরূপ উপহার প্রদানকারী, অর্থাৎ গোদাতা।।
    এই সকল প্রমাণ বিচার করার পর স্বীকার করতেই হয় যে সমাজের পরম্পরা থেকে উপলব্ধ ভাবনা, জনসাধারণের সংস্কার, যে কোনও পুস্তক থেকে অথবা যে কোন বিদ্বান ব্যক্তির থেকে প্রাপ্ত প্রমাণ অপেক্ষাকৃত বলশালী। একদিকে যেমন, কিছু মাংসাহারী আছে অপরদিকে ঠিক তেমনই কিছু শুদ্ধ শাকাহারী রয়েছে। যারা মাংস আহার রূপে গ্রহণ করেন না, তাদের গোমাংসের প্রতি ঘৃণা অবশ্যই আছে কিন্তু মাংসাহারীদের মধ্যেও ৯৯% ভাগেরও অধিক ব্যক্তিগণ গোমাংস খাদ্যরূপে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকার করেন না। মাংসাহারী কিংবা শাকাহারী উভয় শ্রেণীর ব্যক্তিগণ গোমাংস ত্যাজ্য বলে মনে করেন এবং গো-কে মাতৃতুল্য পূজনীয় বলে স্বীকার করেন।
    “গবো বিশ্বস্যমাতরঃ” গাভী বিশ্বের মাতা।