• সর্বশেষঃ

    বেদে গোরক্ষা অথবা গোহত্যা? পর্ব - ২

    বৰ্তমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাসমূহ—
    ম্যাক্সমূলর, মোনিয়র উইলিয়ামস, গ্ৰীফিথ্ প্রভৃতি সংস্কৃতের ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমস্যা ছিল যে, তাদের পরম্পরানুগত রীতিতে সংস্কৃত পাঠের সুযোগের অভাব। স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর ব্যক্তিগত অনুভব ছিল এই যে, পশ্চিমী পণ্ডিতগণের নিকট সংস্কৃত পত্রও অবোধ্য ছিল। তাদের মধ্যে অনুসন্ধান কার্যের পটুতা, কোষ নির্মাণ ইত্যাদির জ্ঞান ছিল এবং তারা কয়েকটি উপযোগী কর্মের নিদর্শন রেখে গেছেন। তাদের পুরাবিদ্যা, ভারতীয় ঐতিহ্য (Indology) ইত্যাদির মধ্যে স্বার্থ নিহিত আছে। খৃষ্টান ধৰ্ম প্রচারের প্রচ্ছন্ন কামনা পরিলক্ষিত হয়।
    পরম্পরা অনুযায়ী সংস্কৃত বিদ্বান্ ও অধ্যাপকদের অভাব বৰ্ত্তমান। বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়। সুতরাং তাঁদের দ্বারা মূলগ্রন্থের অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করা সম্ভবপর হয়না, কারণ তারা পূর্বসূরীদের গ্রন্থসমূহ থেকে জানার চেষ্টা করেন। অনুসন্ধানের নামে প্রয়োজনীয় তথ্য সামগ্ৰী মূল গ্রন্থ থেকে অল্প ও পূর্ব বিদ্বানগণ রচিত গ্ৰন্থ সমূহ থেকে অধিক গ্রহণ করা হচ্ছে।

     ইউরোপ এবং বিশেষ ভাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ডংকা বাজছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বোডেন্ চেয়ার নামক একটি চেয়ার (ট্রাস্ট) স্থাপন করা হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবলমাত্র সংস্কৃত চর্চা ও প্রচারের জন্য ঐ ব্যবস্থা করা হয়নি বরঞ্চ খৃষ্টান ধর্মের প্রচার ও গ্রাম্য ভারতীয়দের খৃষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা শুরু হয়। প্রো. মোনিয়র উইলিয়াম্স-এর বক্তব্য দেখুনঃ That the special object of his (Boden’s) munificent request was to promote the translation of the scriptures into Sanskrit, so as to enamble his countrymen to proceed in the “conversion of the natives of India to the Christian religion."
    মোনিয়র উইলিয়ামের উক্তি উদ্ধৃতি করার তাৎপৰ্য্য এই যে লণ্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত পঠনপাঠনের নিমিত্ত বোডেন ট্রাস্ট “বোডেন চেয়ারের” স্থাপনা করা, যার মূল উদ্দেশ্য ধাৰ্মিক গ্ৰন্থসমূহের বাংলায় অনুবাদ করার মাধ্যমে ভারতীয়দের খৃষ্টধর্মে রূপান্তরিত করার কাজে ইংলণ্ডের ব্যক্তিগণ অগ্রসর হতে পারেন।
    এই যোজনার মূলে পূর্ব পরিকল্পিত ধর্মান্তরিত করার যেরূপ মানসিকতা কাজ করছিল তা বিচার্য বিষয়। ম্যাক্সমূলর আদিগণের কার্য পদ্ধতি থেকে তা বিচার করা যায়। সঙ্গে সঙ্গে তাদের সাহিত্য, ইতিহাসের প্রামাণিকতা সম্পর্কে এক বিশাল প্রশ্নচিহ্ন থেকে যায়। মোনিয়র উইলিয়াম-এর “Sanskrit English Dictionary” আজও উক্ত বিষয়ের সাক্ষ্য বহন করছে। এ সকল ইংরেজদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের বৃহৎ পরিকল্পনা সমূহের একটি অঙ্গ। এই পরিকল্পনার কর্ণধার ছিলেন লর্ড “মেকলে”। তিনি ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে খৃষ্টান ধর্ম প্রচারের জন্য ব্যাকুল ছিলেন। ঐ পরিকল্পনার বৃহৎ অঙ্গ ছিল ইংরেজি ভাষাকে ভারতীয় শিক্ষার মাধ্যম রূপে প্ৰতিষ্ঠা করা। খৃষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করার প্রমাণ লর্ড মেকলের উক্তিতে পরিলক্ষিত হয়।
    "English Education would train up a class of persons Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, in morals and in intellect.”
    অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষা এমন এক শ্রেণী তৈরি করবে, যারা রক্ত ও বর্ণগত দিক থেকে ভারতীয় হলেও রুচি আচার আচরণ, বিচার ও ব্যবহারে ইংরেজ হবে।”
    ইংরেজ সাম্রাজ্যের নীতি ছিল এটাই, যার কূটনীতি ভারতের স্বতন্ত্রতার পঞ্চাশ বৎসর পরেও বৌদ্ধিক স্বতন্ত্রতা আসতে দেয়নি। প্রোফেসর ম্যাক্সমুলর থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত এবং ইতিহাসের অধ্যাপক এই ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি লাভ করতে সক্ষম হন নি।
    এখন ম্যাক্সমুলারের ভাবনার বিশ্লেষণ করে দেখা যাক—প্রোফেসর ম্যাক্সমূলরের পত্নীকে প্রদত্ত এক পত্র থেকে তাঁর মত একজন বিশ্ববিশ্রুত বিদ্বানের খৃষ্টধর্ম প্রচারের বিষয়ে ধর্মান্ধতার পরিচয় পাওয়া যায়। পত্রের ভাষা এবং ভাবনা অনুযায়ী বিচার করুন যে এই বিদ্বান ব্যক্তি বিদ্যা-ভারতীয় বিদ্যার (Indology) ছদ্মরূপ প্রয়োগের মাধ্যমে ভারতবাসীকে কোন ধর্মান্ধতার অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এটি কি জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রচার কিংবা ধাৰ্মিক ছল? ম্যাক্সমূলার নিজের পত্নীকে পত্রে লেখেন ।
    “I hope I shall finish that work (the publication of the Rig Veda with its English translation) and I feel convinced, though, I shall not have to see it Yet, this edition of mine (of the Rig Veda) and the translation of Vedas will hereafter tell to great extent on the fate of India and on the growth of millions of souls in that country. It is the root of their religion and to show them what the root is, I feel sure, the only way of uproating all that has been sprung from it during the last three thousand years.” (Life & letters of F Maxmuller.)
    অর্থাৎ “আমার আশা যে ঐ কাজ (বেদের অনুবাদ) আমি সম্পূর্ণ করব এবং আমার বিশ্বাস যে আমি যখন থাকব না তখনও আমার ঋগ্বেদের এই সংস্করণ এবং বেদের অনুবাদ ভারতের ভাগ্য এবং লক্ষ ভারতীয়দের আত্মিক বিশ্বাসে সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। বেদ তাদের ধর্মের মূল এবং এই মূল তাদের সামনে প্রদর্শন করা একমাত্ৰ অসংদিগ্ধ প্রক্রিয়া যা ঐ সকল (বিশ্বাস-ভাবনা-শ্রদ্ধা) যা গত তিন হাজার বৎসর ধরে অঙ্কুরিত হয়েছে তা উৎপাটনের একমাত্র উপায়।”
    তথাকথিত বিদ্বান ও অধ্যাপকমণ্ডলী ভারতবর্ষে নিষ্ঠুরতার সঙ্গে খৃষ্টধর্ম প্রচারে উতলা হয়ে উঠেছিলেন, তার প্রমাণ ভারতমন্ত্রী (Secretary of State for India) ড্যুক্ আর্গায়লের প্রতি ১৬ই আগষ্ট ১৮৬৮ সালে লিখিত ম্যাক্সমূলরের পত্র থেকে পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন
    “The ancient religion of India is doomed and if christianity does not step in, whose fault will it be?( বেদো কা যথার্থ স্বরূপ পৃ-৩৩)
    অর্থাৎ ভারতের প্রাচীন ধর্ম নষ্ট হবে, কিন্তু, যদি খৃষ্টধর্ম ঐ স্থান গ্রহণ করতে সক্ষম না হয় তবে কাকে দোষী করা হবে? (অর্থাৎ এটি সরকারের দোষ বলে পরিগণিত হবে কারণ বিদ্বান ও বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আপন কাৰ্য সম্পন্ন করেছে।)
    ভারতীয় বিদ্বানগণ খৃষ্টান বিদ্বানদের জ্ঞান-বিদ্যার সেবক রূপে স্বীকার করে এদের বিশ্বাস করে নিতেন। মূল গ্রন্থের পাঠ ব্যতিরেকেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। মান্যবর শ্ৰী বালগঙ্গাধর তিলক Antic Home in the Vedas নামক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিলক মহারাজ মূল সংস্কৃত গ্রন্থ পাঠ না করে, কেবল ইংরেজি অনুবাদ পড়ে ও তারই উপর নির্ভর করে উক্ত মহত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেন। এই তথ্য তিনি শ্রী রমেশচন্দ্র বিদ্যারত্নের নিকট স্বীকার করেন। শ্রী বিদ্যারত্নজী পাঁচদিন ধরে আলোচনা ও বিচারের মাধ্যমে যখন তিলকজীকে তাঁর ভুলগুলির উপর আলোকপাত করান, তখন তিনি স্বীকার করেন যে তিনি সংস্কৃত মূল গ্রন্থ এবং বেদের মূল না পড়েই কেবল ইংরেজি অনুবাদই পাঠ করেছিলেন।
    (দেখুন—বৈদিক সম্পত্তি, প্রথম সংস্করণ, পৃ-৯৯)
    ১। বিকাশবাদ অনুসারে মানবজাতি বানর(আজকের যুগের বানর নয়) থেকে বনমানুষ হয়েছে। এবং বানর থেকে বিকশিত হয়ে মানব হয়েছে। বানর শুদ্ধ শাকাহারী প্রাণী, বনমানুষও শাকাহারী। প্রাচীন কালে, ফলমূল বন প্রভৃতি অনেক
    বেশি ছিল, ধরণীতে ফলমূলের অতিরিক্ত বন্য অন্ন ও পর্যাপ্ত পরিমাণে পাওয়া যেত, প্রাকৃতিক নিয়মেই সহজলভ্য ছিল। “বাদী তোষন্যায়” এর দ্বারা যদি বিকাশবাদের চক্রকে মেনে নেওয়া হয়, তবুও একথা স্বীকার করতেই হবে যে, তখন ফলমূলের আধিক্য থাকায় আদিম কালের মানব গোষ্ঠীর মাংসাহারী হবার প্রয়োজনীয়তা ছিল না। বানর মাংসাহারী নয় অথচ বানরের বিবর্তনে মানুষ মাংসাহারী রূপে পরিণত হল। কেন ? কি ভাবে?
    ২। মানবজাতি ভিন্ন, সমান পষবাত্মিক জাতি ; যে জাতির নরনারী সন্তানের জন্ম দাতা তারা একজাতি। কিন্তু প্রকৃতিগত ভাবে মানুষ মাংসাহারী নয়। মাংসাহারী জীব ও মানুষের প্রকৃতিতে সুস্পষ্ট পার্থক্য দেখা যায়। সেগুলি হল
    (ক) শাকাহারী প্রাণী ঠোট দিয়ে গস করে জল পান করে, মাংসাহারী জিভ দিয়ে চপ্ চপ্ শব্দ করে জলপান করে। মানুষ, গরু, মোষ প্রভৃতি মুখ দিয়ে গস করে জল পান করে। বাঘ, সিংহ, কুকুর, সাপ প্রভৃতি জিভ দিয়ে জল পান করে। অতএব মানুষ শাকাহারী।।
    (খ) শাকাহারী অন্ধকারে দেখতে পায়না, মাংসাহারী রাত্রে দেখতে পায়। মানুষও রাত্রে দেখতে পায় না। বাঘ, সিংহ, বেড়াল আদি রাত্রে দেখতে পায়।।
    (গ) শাকাহারীর শরীরে ঘাম হয়, মাংসাহারীর শরীরে ঘাম হয় না। মাংসাহারী মুখ খুলে জিভ বার করে হাঁফায় এবং তাদের জিভ থেকে লালা ক্ষরণ হয়।
    (ঘ) মাংসাহারী প্রাণীর সন্তানোৎপত্তি ক্রিয়া, মৈথুনকালে বন্ধনের সৃষ্টি করে, কিন্তু শাকাহারীর মধ্যে তা হয় না।
    (ঙ) মাংসাহারী প্রাণীর ক্ষুদ্রান্ত ছোট হয়, সেখানে অধিক অম্ল নিঃসৃত হয়। মাংসের পচনকার্য্যের নিমিত্ত অধিক এ্যাসিডের প্রয়োজন হয়। সেইজন্য মাংসাহারে আসক্ত ব্যক্তি মদ্যপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। শাকাহারীর পচন প্রণালী (ক্ষুদ্রান্ত) বড় হয় এবং স্বল্প অম্ল নিঃসরণ করে।
    (চ) মাংসাহারীর নখের ভিতর খালি হয় যা থাবার মধ্যে বন্ধ থাকে কিন্তু শাকাহারীর নখ সর্বদা উন্মুক্ত থাকে।
    (ছ) মাংসাহারী প্রায়শঃ শাকাহারী পশুর মাংস খাদ্যরূপে গ্রহণ করে, মাংসাহারীর মাংস নয়।
    ৩। যে সকল তথাকথিত বুদ্ধিবাদের দম্ভে দাম্ভিকেরা বেদকে জ্ঞান বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার গ্রন্থরূপে স্বীকার করতে সংকোচ বোধ করেন, তাদের কাছে এটিও একটি কারণ, ওদের মতানুসারে বেদসমূহের নির্মাণকারীগণ বনমানুষের সমীপবর্তী ছিলেন। সুতরাং বেদের মধ্যে বিদ্যা ও আদর্শের উন্নতমানের বক্তব্য থাকা সম্ভব নয়। Nearer the animal, lesser the wisdom.
    বেদে গাভী সম্মান ও পূজার দৃষ্টিতে উপযোগী এবং অগ্ন রূপে স্বীকৃত। বেদে যজ্ঞের নাম অধ্বর। অর্থাৎ যে ক্রিয়া হিংসা রহিত। বৈদিক শব্দের ব্যাখ্যাকারী আচার্য যাস্ক তাঁর নিরুক্ত গ্রন্থে লিখেছেন যে—“ধ্বরতীতি হিংসাকর্মা তত্তপ্রতিষেধঃ অধ্বরঃ” যজ্ঞ কৰ্ম হিংসার বিরোধী। যজ্ঞকে সর্বথা হিংসা রহিতই হওয়া উচিত। গোমেধ, অশ্বমেধ ইত্যাদি যে কোন প্রকার যজ্ঞে পশুবধের বিধান কোথাও পাওয়া যায় না। বেদে, বেদভক্ত জনগণের মনে তাদের বিচার কিংবা সংস্কারে, গোবধ অথবা গোমাংসের বিষয়ে কোনও প্রশ্নের অবকাশ নেই।


    হাজার বছর ধরে বিদেশীদের সঙ্গে ভারতবাসীদের সম্পর্ক ও আচারবিচার ব্যবহারের আদান প্রদান চলে আসছে। সময়ের গতির সঙ্গে দেশের কত মানুষ মাংসাহারী হয়েছেন। খৃষ্টান ও মুসলমানদের মধ্যে মাংসাহার কিংবা গো মাংস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা বা না করার কোন বাছ-বিচার নেই। কিন্তু হিন্দুদের মধ্যে, আৰ্য সভ্যতার মধ্যে যাঁরা মাংসাহারী তারাও গোমাংস ভক্ষণকে পাপ ও অধর্ম বলে মনে করেন। গো-হত্যাকারীরা আর্য সংস্কৃতি নষ্ট করার হাজারো চেষ্টা করছে--বেদের ব্যাখ্যা দূষিত করেছে, গ্রন্থের মধ্যে প্ৰক্ষেপ-ভেজাল দেবার চেষ্টা করেছে; কর্মকাণ্ডের গ্রন্থ সমূহকে ভ্রষ্ট করেছে, কিন্তু এত সব করা সত্ত্বেও তারা সফল হতে পারেনি। আজ পর্যন্ত আর্য বংশধরদের পরম্পরা সংস্কার এবং বিচারকে ভ্রষ্ট করতে সক্ষম হয়নি। আজও ভারতের আর্য বংশধরেরা, বেদ ভক্ত হিন্দুরা গোধনকে পূজ্যা ও মাতা বলে স্বীকার করেন। জনগণের মনোভাব আজও নির্মল ও নিষ্কলঙ্ক রয়েছে।



     গাভী এবং বেদঃ
    বেদে গাভীকে শ্রদ্ধা সহকারে পালন ও সংরক্ষণ করার বিধান আছে। ঋগ্বেদে গগা হত্যা নিষেধ-

    মাতা রুদ্রাণাং দুহিতা বসূনাং, স্বসাদিত্যানামমৃতস্য নাভিঃ। 
    প্রনুবোচং চিকিতুষে জনায়, মা গামনাগামদিতিং বধিষ্ট৷
    (ঋগ্বেদ০ ৮-১০-১-১৫)
    অর্থাৎ- গাভী রুদ্রব্রহ্মচারী বিদ্বানগণের মাতা, নির্মাতা। দুষ্টের রোদনকর্তা (রোদয়তি তস্মাৎ রুদ্রঃ) বিদ্বান, সৈনিক, সেনাপতি ইত্যাদিগণ গাভীকে মাতৃতুল্য পূজনীয়া বলে মনে করেন। গাভী বসু বিদ্বানগণের পুত্রী। সমাজের সংস্থাপক (বাসয়স্তি তস্মাৎ বসবঃ) ব্যবস্থাপক প্রবন্ধক আদির জন্য গাভী পুত্ৰী-সমা পালনীয়া, রক্ষণীয়া ৰূপে স্বীকৃত। গাভী অমৃতের নাভি, অমৃতের কেন্দ্র। গোরক্ষার দ্বারা চিরজীবন সমাজচেতনা লাভ হয়। অতঃপর বেদ বিচারশীল, চিন্তাশীল পুরুষগণকে আদেশ প্রদান করে যে, ‘গে’ নিৰ্দোষ, নিস্পাপ, অদিতি, অখণ্ডনীয়, অবধ্য সুতরাং তাকে হত্যা করো না। এটিই বেদের আদেশ এবং নিৰ্দেশ। This is mandatory— এটি ধর্মের আদেশ।
    যজুর্বেদে গোহত্যা নিষেধ-

    ইমং সাহস্ৰং শতধারমুৎসং ব্যচ্যমানং সরিরস্যমধ্যে। 
    ঘৃতং দুহানামদিতিং জনাযাগ্রে মা হিংসীঃ পরমে ব্যোমন্।।
    (যজ০১৩-৪৯)
    বেদে রাজার জন্য এই প্রকার উপদেশাত্মক মন্ত্র বর্ণিত আছে।
    উপরোক্ত মন্ত্রের অর্থ এই প্রকার—হে পরোপকারী রাজন! গাভী মানুষের অসংখ্য সুখের সাধন, দুগ্ধের জন্য বিভিন্ন ভাবে পালনীয়া। গো, ঘৃত দুগ্ধ দাতৃ, অদিতি অখণ্ডনীয়া। হে মানব! একে হত্যা করো না। অর্থাৎ কেউই যেন গো হত্যা না করে—এ রকম রাজ্য ব্যবস্থা হওয়া উচিত। This is mandatory for the state,
    এই উপদেশের সরল তাৎপর্য থেকে এটি স্পষ্টভাবেই বোঝা যায় যে, আইনানুসারে রাজার আদেশদ্বারা গো হত্যা সৰ্বথা বন্ধ হওয়া উচিত।
    অথর্ববেদে গোহত্যা নিষেধ-

    “অন্যোন্যমভিহর্যৎ, বৎসংজাতমিবাঘ্ন্যা”
    (অথর্ব ৩-৩০-১)
    এটি সামাজিক কৰ্ত্তব্যের উপদেশ-
    হে মনুষ্যগণ! পরস্পর একে অপরকে এমনভাবে স্নেহ কর, ভালবাসো, যেমনভাবে অহৰ্তব্য গাভী আপন বাছুরকে ভালোবাসে।।
    মহাভারতে গোহত্যা নিষেধ:--

    অঘ্ন্যা ইতি গাবাং নাম, ক এতাহন্তুমৰ্হতি।। মহচ্চকারাকুশলং, বৃষং গাং বা লভেত যঃ।।
                                                              (শান্তি০ ২৬২-৪৭) 
    অর্থাৎ গাভীর অপর নাম অঘ্ন্যা, এরা অবধ্য। এই সকল গোহত্যাকারীদের প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করা উচিত। অথর্ববেদে গুলিবিদ্ধ করার বিধান -

    অথর্ববেদের নিম্ন মন্ত্ৰ লক্ষ্য করুন-
    যদি নো গাং হংসি, যদ্যশ্বং যদি পুরুষম্। 
    তন্তবা সীসেন বিধ্যামো যথা নোহসি অবীরহা।।
                                                                   (অথর্ব ১-১৬৪) 
    অর্থাৎ—যদি তুমি আমাদের গাভী সকল হত্যা করো, যদি আমাদের ঘোড়া এবং পুরুষদের হত্যা কর, তাহলে তোমাকে সীসের গুলি করে ধ্বংস করা হবে যাতে, তুমি আমাদের আর কোন প্রকার ক্ষতি সাধন করতে না পারো।
    এতগুলো প্রমাণ তো এখানে একত্র করা হল, এছাড়া আরও অনেক প্রমাণ একত্রিত করা সম্ভব। এই সকল প্রমাণ থেকে এটি সুস্পষ্ট যে, বৈদিক সাহিত্যে গো রক্ষার বিধান আছে, কোথাও গোহত্যার বিধান নেই। অনেক ক্ষেত্রে গো ঘাতককে কঠোর দণ্ডদানের বিধানের উল্লেখও পাওয়া যায়।
    যারা বলে যে বৈদিক পরম্পরায়, প্রাচীন ভারতে গো হত্যা ও গো মাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিল, তারা নিশ্চয় কোন অন্তর্নিহিত স্বাৰ্থ অথবা ভারতীয় কিংবা বৈদিক সংস্কৃতি-বিরুদ্ধ কোন কপট চক্রান্তের শিকার।
    সহস্ৰ বৎসর যাবৎ বিদেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। মহারাজা রঘু কিংবা শ্রী রামচন্দ্রের সময় পর্যন্ত আর্য সংস্কৃতি, আর্য আচরণ ও ব্যবহার সংসারে প্রকট ছিল। অসুর এবং আসুরিক সংস্কৃতি তখনও ছিল। কিন্তু অপ্রকট অবস্থায় ছিল। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে তাদের প্রভুত্ব ঘটে। অনার্য আদর্শের মিশ্রণ হয়, আর্য গ্রন্থ ও স্মৃতি সমূহের মধ্যে ভেজাল দেওয়া শুরু হয়। মহাভারত যুগের কিছু পূর্বে ভারতবর্ষের আর্য রাজা অনার্যদের মিশ্রণের শিকার হতে শুরু করেন। সুরা-সুন্দরী, মাংসের অল্পস্বল্প প্রবেশ হতে শুরু করে কিন্তু এ বিষয়ে সমাজের নেতা ও জনতার সুস্পষ্ট সাবধানতার ঘোষণা ছিল—
    সুরামৎস্যাঃ পশোর্মাংসমাসবং কৃশরৌদনম্। 
    ধূৰ্তৈঃ প্রবর্তিতং হ্যেতদ্ নৈতদ্ বৈদেষু বিদ্যতে৷৷
                                                            (শান্তি পর্ব ২৬৫/৯)
    ভারতবর্ষের ধর্মপ্রাণ জনতা রাম-কৃষ্ণের আদর্শের সম্মানকারীরা আজও গোহত্যা জঘন্য পাপ বলে মনে করে।
    গোহত্যাকারী সাংস্কৃতিক ধারার দূষণকারীর অনুচিত প্রয়াস এবং পাপ বৰ্ত্তমান থাকা সত্ত্বেও সুভাবনাসমূহ অদ্যবধি সুরক্ষিত রয়েছে। জনসাধারণের মনে গাভীর প্রতি অনুরাগ, গোমাংস ভক্ষণের প্রতি ঘৃণা এবং ক্ষোভ আজকের দিনেও পরিলক্ষিত হয়।