• সর্বশেষঃ

    বেদে গোরক্ষা অথবা গোহত্যা? পর্ব - ১

    বেদে গোরক্ষা অথবা গোহত্যা?
    লেখকঃ প্রো. উমাকান্ত উপাধ্যায়
    আচাৰ্য্য আর্য সমাজ, কলকাতা

    প্রকাশক আর্য সমাজ বড়বাজার।
    ১, সদরউদ্দীন লেন, কলকাতা-৭০০০০৭



    বেদে গোরক্ষা অথবা গেহত্যা?প্রশ্নের মূল :
    সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব যুগ-যুগান্ত ধরে চলে আসছে। সত্যযুগে এই প্রকার কোন দ্বন্দ্বের ইতিহাস পাওয়া যায় না, কিন্তু ত্রেতাযুগে মহারাজ রঘু : থেকে শুরু করে শ্রী রামচন্দ্র পর্যন্ত বহু দ্বন্দ্ব প্রতীয়মান। শ্রী রামচন্দ্রের সময়ে একদিকে রাক্ষস-সংস্কৃতি অন্যদিকে দেব এবং আর্যগণ ছিলেন। রাম রাবণের যুদ্ধের সঙ্গে ঐ সংস্কৃতির সংঘর্ষের নির্ণায়ক ইতিহাসের সৃষ্টি হয়, এবং রাক্ষস সংস্কৃতিতে ভাটা পড়ে। এই সংস্কৃতি ইউরোপের কিছু অংশে এবং আফ্রিকা অষ্ট্ৰেলিয়া পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ইউনানী, আরব, হুড়ো ইত্যাদির মধ্যে রাজকীয় সংঘর্ষের সঙ্গে সঙ্গে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব পরিলক্ষিত হয়। দ্বাপরে শ্রীকৃষ্ণের সময়ে এই রাক্ষস অসুর সংস্কৃতির প্রতিনিধি রূপে মগধের জরাসন্ধ এবং মথুরার কংসকে চিহ্নিত করা যায়। আসুরিক বিচারধারার প্রচার প্রসার করতে গিয়ে কংসকে যখন অধিক পরিমাণে কাঠিণ্যের সম্মুখীন হতে হল তখন তাঁর পরামর্শদাতা মন্ত্ৰীগণ এক যোজনা গ্রহণ করেন।

    “তস্মাৎসর্বাত্মনা রাজন্ ব্ৰাহ্মণান ব্ৰহ্মবাদিনঃ। 
    তপস্বিনো যজ্ঞশীলান্ গাশ্চ হন্মো হবির্দুধাঃ।।“
                                                         (শ্ৰী মদ্ ভা ১০-৪-৪০)
    অর্থাৎ—হে রাজন্। যদি বেদ-ব্ৰাহ্মণ গো ভক্তদের পরাজিত করতে সংকল্প করেন, তাহলে সর্বান্তকরণে সম্পূৰ্ণ শক্তি দিয়ে ব্ৰহ্মবাদী বেদ প্রচারক, তপস্বী যজ্ঞশীল ব্রাহ্মণ এবং যজ্ঞের হবির সহায়ক গোরুগুলি হত্যা করান।
    এই ছিল গো-ব্রাহ্মণ বেদ বিরোধী আয়োজন। ভারতে এই আয়োজনের হোত ছিলেন কংস এবং জরাসন্ধ প্রভৃতিগণ। এছাড়া বিদেশেও এই প্রকার নেতার সন্ধান পাওয়া যায়।
    পরম্পরা অনুযায়ী ভারতীয় ঐতিহাসিক বিদ্বানগণের বিচারে, মহাভারতের যুদ্ধের প্রায় এক হাজার বৎসর পূর্বে স্বার্থী, অনাৰ্য্য, আসুরিক বৃত্তি অঙ্কুরিত হতে শুরু করে এবং মহাভারতের সময়ে এদের সমর্থক যত্র তত্র দৃষ্টি গোচরে আসতে শুরু করে। মহাভারতের শান্তি পর্বে পাওয়া যায়-

    সুরামৎস্যাঃ পশোর্মাংসম্ আসবং কৃশরৌদনম্। ধূর্তৈঃ প্রবর্তিতং যজ্ঞে, নৈতদবেদেষু বিদ্যতে।।
    অব্যবস্থিতমার্যাদৈঃ বিমূঢৈর্নাস্তিকৈনৱৈঃ। সংশয়াত্মভিরব্যক্তৈর্হিংসা সমনুবর্ণিতা।।
    (শান্তিপর্ব অ ০ ২৬৩-৯)
    উপরিউক্ত শ্লোকের ভাবার্থ এই রূপ- যজ্ঞে মদ, মৎসসেবন, পশুমাংস, মাদক দ্রব্য ইত্যাদির প্রয়োগ ধূৰ্ত্তদের কীৰ্ত্তি। মর্যাদাভ্ৰষ্ট সংশয়াত্মা, মুখ নাস্তিকরাই পশু হিংসার প্রচার করে। ‘ন এতদ্ বেদেষু বিদ্যতে”—অর্থাৎ বেদে এই সকলের প্রমাণ পাওয়া যায় না। এটি কেবল মাত্র ধূৰ্তর্গণের চেষ্টা।
    এ থেকে বোঝা যায় যে মহাভারতের যুগে পশু হিংসা আদির প্রচার শুরু হতে থাকে। জনতা, পণ্ডিত, ব্রাহ্মণ, যাজ্ঞিক কর্মকাণ্ডী তা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করে। এই প্রকার প্রক্ষেপ-মিশ্ৰণ বেদে করানো সম্ভব হয়নি, কারণ এটিকে ধর্ম বলে স্বীকার করে কণ্ঠস্থ করা হত। কিন্তু ব্রাহ্মণ-আরণ্যক-স্মৃতিতে মাঝে মধ্যে নিজেদের স্বার্থ বিধানের অনুপ্রবেশ পরিলক্ষিত হয়। “ধূর্তৈঃ প্রবর্তিতং হ্যেতেদ্”। এই প্রকার প্রক্ষেপের ঘোর অন্যায় দেখে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী নির্দ্বন্দ্ব ঘোষণা করলেন যে, বেদ সংহিতা স্বতঃ প্রমাণ এবং অন্যান্য গ্রন্থ যদি বেদের অনুকূলে হয় তবেই প্রমাণ বলে স্বীকার করা সম্ভব, অন্যথায় নয়। অতএব বেদ স্বতঃ প্রমাণ, অন্যান্য বেদ বিরুদ্ধ গ্রন্থ প্রমাণ নয়।
    শ্ৰী মাধ্বাচার্য আনন্দতীর্থজী মহাভারতের তাৎপর্য নির্ণয় করতে লিখছেন-

    ক্কচিদ্ গ্রন্থান্ প্রক্ষিপন্তি, ক্কচিদন্তরিতনাপি। 
    কুর্য়ুঃ ক্কচিচ্চ বত্যাসং, প্রমাদা ত্ত্বচিদন্যথা।।
    অনুৎসন্না অপি গ্রন্থাঃ, ব্যাকুলা ইতি সৰ্বশঃ।।
    (কুম্ভ ঘো0 সংস্ক পৃ ৯০৭) 
    অর্থাৎ—সভ্যতা সংস্কৃতির ধ্বংসকারী ধূর্তগণ কোথাও কোথাও প্রক্ষেপ গ্রন্থে ভেজাল, কখনও কখনও পরিবর্তন ঘটিয়ে গ্রন্থে পাঠান্তর করে দেয় এবং ধূৰ্ত্ততাবশতঃ গ্রন্থকে ভিন্নরূপ প্রদান করে। এই প্রকার ঘটনার জন্য যে সকল সৎগ্রন্থ নষ্ট হয়নি সেই সকল গ্রন্থের প্রতি উৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়।
    এই বক্তব্য কোনও আর্য সমাজের বিদ্বানের নয়, এ তত শ্ৰী মাধ্বাচার্য আনন্দতীর্থ মহাশয়ের বেদনা। যে কোন নিরপেক্ষ সত্যাগ্রহী বিদ্বান এই প্রকার প্রক্ষেপ কাণ্ডকে অস্বীকার করতে পারে না।


    মহাভারতের পরবর্তী মধ্যকালের পরিস্থিতিঃ
    মহাভারতকাল পৰ্য্যন্ত হিংসা বিধানের আধিক্য ছিল না। কিন্তু নির্ণায়ক বিচক্ষণ ব্যক্তিগণের এই প্রকার ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, “ধূৰ্ত্তৈঃ প্রবর্তিতমেতদ্” ধূৰ্তগণের প্রচার। মহাভারতকালে বিনাশকারী যুদ্ধের ফলে সমস্ত ব্যবস্থা অত্যন্ত বিকৃত রূপ ধারণ করে। পঠনপাঠন, গুরুকুল ও ঋষি আশ্রমের সমস্ত কিছু ওলটাপালট হয়ে পড়ে। ঋষি-যুগ শেষ হল। মহর্ষি ব্যাস এবং জৈমিনি পরম্পরানুযায়ী অন্তিম ঋষি বলে পরিগণিত হলেন। মহামুনি পাণিনি, পতঞ্জলি প্রভৃতির সঙ্গে সঙ্গে মুনিযুগের সমাপ্তি হল। ঋষিমুনি যুগের যবনিকার পরবর্তী সময়ে স্বার্থপর ধূৰ্ত্তগণের মাধ্যমে সমাজ প্রতারিত হতে শুরু করে। পশুহিংসাদির প্রচার আরম্ভ হয়। কিন্তু পশু হিংসা, মদ্যপান ইত্যাদির প্রবৃত্তি জনসাধারণকে সম্পূর্ণভাবে গ্রাস করতে সক্ষম হয়নি। জনতা সামান্যরূপে পশু হিংসা, মদ্যপান, ব্যভিচার ইত্যাদিকে নিজেদের থেকে দূরে রাখে, এবং ইহাকে কদাচার, দুরাচার বলে গণ্য করতে শুরু করে, যার অদ্যবধি কোন পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। সহস্ৰ চেষ্টা সত্ত্বেও জনগঙ্গার জীবনচরিত্রের অজস্রধারা আজ পর্যন্ত নিজ পবিত্ৰতা রক্ষা করে চলেছে। বৰ্তমান যুগেও এই সকল কদাচার, কুৎসিত ব্যবহারকে জনসাধারণ পবিত্রতাসদাচারের মোহরে অঙ্কিত করেনি। | জনসাধারণ তখনও গ্রহণ করেনি, এখনও স্বীকার করে না, কিন্তু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিগণ পশুযাগ, মদিরা, ব্যভিচার ইত্যাদির প্রচার শুরু করে, সেও আবার বেদের নামে, বেদের মোহর ব্যবহার করে। বেদের যথাযথ বিদ্বানের অভাবে তাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে বলতে পারা যায় না যে-

    “ধূৰ্ত্তৈঃ প্রবর্তিতং যজ্ঞে, নৈতদ্ বেদেষু বিদ্যতে।”
    সকল বেদের নয়, ধূর্তোদের মায়া। বেদের মধ্যে মাংস, মদিরা, কদাচার দেখে চার্বাক, জৈন, বৌদ্ধ প্রভৃতিগণ বেদের বিরোধ করতে শুরু করেন।


    স্বামী শংকরাচার্যের আগমন—মহাভারতের আড়াই-তিন হাজার বছর পর জগৎগুরু স্বামী শংকরাচার্যের জন্ম। বালক ব্রহ্মচারী, সন্ন্যাসী, এই অদ্ভুত শাস্ত্ৰজ্ঞ বিদ্বান ধর্মোদ্ধারে প্রবৃত্ত হন। বৌদ্ধ, জৈন, নাস্তিক, চার্বাক ইত্যাদির প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু বেদের নামে যে অনর্থ ও অপপ্রচার চলছিল, তার জড়োৎপাটন করার পূর্বেই ৩০-৩২ বৎসরের অল্পায়ুতেই তিনি দেহ ত্যাগ করেন। ফলে বেদের নামে যে কদাচার, পশুহিংসা, মদ্যপানাদি চলছিল তা বর্তমান রইল।।


    সায়ণাচার্যের আগমন-
    সায়ণাচার্যের আগমনকাল খৃষ্টাব্দ চতুর্দশ শতাব্দীতে, স্বামী শংকরাচার্যের প্রায় ১৬০০ বৎসর পরে। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক যাগ-যজ্ঞ চলছিল। জৈন বৌদ্ধগণের ভাটা পড়ায় সাম্প্রদায়িক বামমার্গী কর্মকাণ্ডের প্রচণ্ডতা পরিলক্ষিত হয়।
    সায়ণাচার্য বুক নরেশের মন্ত্রী ছিলেন। বিজয়নগর গোলকুণ্ডার রাজা হিন্দু সংস্কার-যুক্ত ছিলেন। উত্তর ভারতে মুসলমান রাজারা প্রবল পরাক্রমী হতে শুরু করেন। এখানে হিন্দুদের প্রতি অত্যাচার চলছিল। বুক নরেশ সাণাচার্যকে হিন্দু ধর্মের পুস্তক সমুদায় ভাষ্য করার জন্য নিযুক্ত করেন। আজ থেকে প্রায় ৬০০ বৎসর পূর্বে সাম্প্রদায়িকতা, ধূৰ্ত্ততা এবং মুসলমানদের হাত থেকে রক্ষা পাবার ভাবনা চিন্তা শক্তিশালী হতে শুরু করে। সায়ণাচার্যের সময়ে সামাজিক, সাম্প্রদায়িক এবং ধার্মিক পৃষ্ঠভূমি ছিল ঠিক এই প্রকার। সুতরাং আচার্য সায়ণের ভাষ্যকে যথার্থবক্তা, আপ্তপুরুষ এবং ঋষিগণের পংক্তিতে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভবপর নয়। ওঁর মধ্যে তাৎকালীন ত্রুটি, সাম্প্রদায়িকতা ও ঋষি পরম্পরা থেকে পৃথকতা সুস্পষ্ট। এ বিষয়ে ঋষি অরবিন্দের সম্মতির প্রতি দৃষ্টিপাত করা বাঞ্ছনীয়—(বেদোঁ কা যথার্থ স্বরূপ পৃ-৫৫-৫৬।)

     যদি কোন বিদ্বত্তাপূর্ণ চাতুর্যের কোষ থাকে, সাধারণতঃ বিদ্বতার যেমন গম্ভীর নির্ণায়ক শক্তি, নিশ্চিত রুচি, যথার্থ সমালোচনাত্মক, তুলনাত্মক নিরীক্ষণ, ঋষিদের সাক্ষাৎ দৃষ্টি সম্পন্ন এবং অত্যন্ত সাদামাঠা বুদ্ধি হতেও দূর এবং তা থেকে রহিত, যার মধ্যে পূর্ব চিন্তাশীলতানুযায়ী বেদমন্ত্র সকল প্রয়োজনানুযায়ী পরিবর্তন ঘটিয়ে প্রয়োগের প্রচেষ্টা করা হয়েছিল সেটি সাণাচার্যের ভাষ্য—যা বিশাল, চমৎকার প্রথম অপরিস্কৃত সামগ্রী রূপে ততটাই উপযোগী এবং বৈদুষ্যপূর্ণ।
     ইউরোপের বিদ্বানগণের সংস্কৃত ভাষাদির বিষয়ে তেমন যোগ্যতা না থাকায় মূলবেদ বোধগম্য হয়ে উঠেনি। তাঁরা সাধারণতঃ মধ্যকালের আচার্যগণসায়ণাচার্য, মহীধরাচার্য আদিগণের ভাষ্যের আধারে নিজেদের মতামত প্রদান করতেন। মাঝে মধ্যে তারা এই কথা স্বীকারও করতেন। শ্রী ক্লেটন (Claton) সায়ণাচার্যকে আধার এবং শ্রী গ্রাফিথ মহীধরাচার্যকে নিজের উপজীব্য বলে উল্লেখ করেন। গ্রাফিথ তার অনুদিত যজুর্বেদ-এর ভূমিকায় স্বীকার করেছেন
    “All that I have attempted to do is to give a faithful translation to the best of my ability, of the texts and sacrificial formulas of Vedas, with just sufficient commentary ; chiefly from Mahidhar, to make them intelligible.”
    অর্থাৎ “মহীধরের ভাষ্যের আধারে আমার সমস্ত যোগ্যতা ও সামৰ্থ অনুসারে আমি যজুর্বেদের মন্ত্র ও যজ্ঞকে বোধগম্য করাতে প্রচেষ্টা করেছি মাত্র।”
    মহীধারাচার্য স্বয়ং তান্ত্রিক ছিলেন এবং তাঁর ভাষ্যে পশুহিংসা, অশ্লীলতা ইত্যাদির সমর্থন করা প্রাচীন ঋষিদের পরম্পরার বিরুদ্ধে গিয়েছে। এই সকল সাহিত্য হাজার বছরের পুরোনোও নয়, ফলে বৈদিক সিদ্ধান্ত অথবা প্রাচীন আর্য পরম্পরার সম্বন্ধে সত্য-বাস্তব মতামত প্রতিষ্ঠিত হয়না। আর্য পরম্পরার জন্য সেটিকে আধার রূপে গণ্য করা অন্যায়।।




    বেদে গোরক্ষা অথবা গোহত্যা? সকল পর্বের লিঙ্কঃ