• সর্বশেষঃ

    গীতা সমীক্ষাঃ পর্ব ১ঃ শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ প্রদর্শনেই কি প্রমাণ হয় তিনি ঈশ্বর?


    ১। ভাগবত পুরাণে শ্রীকৃষ্ণ তার মা যশোদাকে নিজের মুখের ভেতর বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।
    (যত দিন যায় তত কৃষ্ণের দুষ্টুমি বাড়ে। কিছুতেই তাকে আর সামলানো যায় না। প্রতিবেশী প্রায় সকলেই তার নামে অভিযোগ জানায়। মা যোশদা সব শোনেন। তার গোপালকে শাসন করবেন কী ছোট্ট ছোট্ট হাতে যখন আঁকড়ে ধরে তখন সব ভুলে যান যশোদা। তাঁর ছোট্ট গোপাল যে রয়েছে জীবন জুড়ে। তাঁর আদরের গোপাল।
    অনেকেই এসে যশোদাকে বলে, তোমার গোপাল অনেক ছল-চাতুরি করতে শিখেছে। বড় হলে কী যে হবে! বাঁধা বাছুরকে খুঁটি থেকে খুলে দেয়। বাঁধন-হারা বাছুর গাভীর সব দুধ খেয়ে নেয়। এমনকী ননী চুরি করে খেয়ে নেয়। আবার বন্ধুদেরও বিলোয়। কিছু বললে আমাদের বেণি ধরে টানও মারে।
    যশোদা সব শোনেন। মাঝেমধ্যে শাসনও করেন তাঁর আদরের গোপালকে। এভাবেই দিন যায়। ক্রমশ বড় হয় কৃষ্ণ-বলরাম। একদিন হয়েছে কি যশোদাকে কৃষ্ণের গোপ-বন্ধুরা এসে বলল, দেখো না কৃষ্ণ মাটি খেয়েছে। এই অভিযোগকারীদের দলে কৃষ্ণ-ভ্রাতা বলরামও ছিল। কৃষ্ণ বলল, ওরা সব মিছে কথা বলছে। আমি মাটি খাইনি। মা তুমি দেখো না আমি হাঁ করছি। তাহলে তো আমি মিছে না সত্যি বলছি।
    যশোদার সামনে বালক কৃষ্ণ একটা বিশাল হাঁ করল। এ কী দেখছেন যশোদা! কৃষ্ণের মুখের ভিতর সারা বিশ্বচরাচর! মাতা যশোদাকে বিশ্বরূপ দর্শন করাল বালক কৃষ্ণ। এসব দেখে যশোদা অবাক! এ কী দেখালো তাঁর গোপাল! পরম মমতায় আদর করতে লাগলেন যশোদা। বুঝতে পারলেন তাঁর আদরের গোপালের দেবমায়া!)


    ২। শ্রীকৃষ্ণ মহাভারতে কৌরব সভায় বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।




    ৩।ভাগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।



    ৪। বামন আবতার কতৃক বলিকে বিশ্বরূপ দর্শণঃ(ভাগবত ৮/১৪)



    এগুলো ছিলো সব বিষ্ণুর অবতারের উদাহরণ ( পুরাণ মতে ) ।


    কিন্তু একমাত্র বিষ্ণু/কৃষ্ণই কি বিশ্বরূপ প্রদর্শন করেছেন?

    না

    মোটেও তা নয়।

    নিচের উদাহরণগুলো দেখুন।

    ৫। দক্ষের কন্যা সীতা জন্মের পরেই দক্ষকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন:
    কোটী-সূর্যপ্রতীকাশং তেজোবিম্বং নিরাকূলম্ ।
    জালামালা সহস্রাঢ্যাং কালানল শতোপমম্।।
    দংষ্ট্রাকবাল দুর্ধর্ষং জটামণ্ডলমণ্ডিতম্।
    ত্রিশূলববহস্তঞ্চ ঘোবরূপং ভয়ানকম্।।
    সর্বত: পাণি-পাদন্তং সর্বতোহক্ষিশিবোমুখম্।
    সর্বমাবৃত্য তিষ্ঠন্তীং দদর্শ পরমেশ্ববীম্।।
    (কূর্মপুরাণ, পূর্বভাগ ১২।৫২-৫৩,৫৮)

    ৬। বৃহৎসংহিতায় ইন্দ্রের যে বর্ণনা আছে তা বিশ্বরূপের আনুরূপ:
    অজোহব্যয়ঃ শাশ্বত কএরূপো বিষ্ণুর্ববাহঃ পুরুষঃ পুরাণঃ।
    ত্বমন্তক সর্বহবঃ কৃশানুঃ সহস্রশীর্ষা শতমনুবীভ্যঃ।।
    কবিং সপ্তজিহবং ত্রাতারমিন্দ্রমবিতারং সুবেশম্।
    হবযামি শত্রুং বৃত্রহনং সুষেণমস্মাকং বীবা উত্তরে ভবন্তু।।
    (বৃহৎ সং- ৪৩।৫৪-৫৫)

    ইন্দ্র এখানে অজ অর্থাৎ স্বয়ম্ভু, শাশ্বত অর্থাৎ নিত্য, বিষ্ণু,  বিরাহ বিষ্ণুর অবতার, পুরাতন পুরুষ, যম, অগ্নি, সহস্র শির বিশিষ্ট, কবি, সপ্তজিহ্বা সমন্বিত, রক্ষাকর্তা, দেবরাজ, শত্রু, বৃত্রাঘাতী এবং সুষেণ।

    ৭। গণেশ গীতাতে গণেশ রাজা বরেণ্যকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন:
    অসংখ্যবক্ত্র ললিতমসংখ্যাঙ্ঘ্রি কবং মহৎ।
    অসংখ্যনয়নং কোটীসূর্যরশ্মিধৃতাষুধম্।
    (গণেশ গীতা - ৮।৬-৭)

    ৮। ভবিষ্যপূরাণে সূর্য বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন।

    ৯। মার্কেন্ডেও পূরাণে চন্ডির যে বর্ণনা আছে তা বিশ্বরূপের আনুরূপ।
    ব্রহ্মা চন্ডিকে স্তুতি করে বলছেনঃ
    ত্বষৈব ধার্যতে সর্বং ত্বষৈতৎ সূজ্যতে জগৎ।
    ত্বষৈতৎ পাল্যত দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।।
    (চণ্ডী- ১। ৬৮-৬৯)
    -হে দেবী, তুমিই সবকিছু ধারণ কর, তুমি জগৎ সৃষ্টি কর, তুমিই পালন কর, তুমিই প্রলকালে গ্রাস কর।

    ১০। একৈবাহং জগত্যাত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা।
    পৈশ্যৈতা দুষ্ট ময়েব্য বিশস্ত্যা মদবিভূতয়:।।
    (চণ্ডী - ১০। ৮)
    - এই জগতে আমি একাই, আমি ছাড়া আর দ্বিতীয় কে আছে? এই দুষ্ট দেখো- আমার বিভূতি আমাতেই প্রবেশ করছে।

    ১১।বরাহ পুরাণে শিবের বিশ্বরূপ প্রদর্শিত হয়েছে:
    প্রদেশমাত্রং রুচিরং শতশীর্ষং শতোদবম্।।
    সহস্রবাহুচরণং সহস্রাক্ষিশিরোমুখম্।
    অনীযসামণীযাংসং বৃহদবহদ্ বৃহত্তবম্।
    (বরাহ পুরাণ - ১।৯।৬৮)
    - শিব এখানে প্রোদেশ প্রমাণমাত্র হয়েও শতশীর্ষ, শত উদর বিশিষ্, সহস্র বাহু, সহস্র পদ, সহস্র চক্ষু, সহস্র মস্তক ও সহস্র মুখ সমন্বিত। অণু থেকে ক্ষুদ্র হয়েও সর্ববৃহৎ।

    ১২।বায়ু পুরাণেও শিবের বিশ্বমূর্তি বর্ণিত হয়েছে:
    অব্যক্তং বৈ যস্য যোনিং বদন্তি
    ব্যক্তং দেহং কালমন্তর্গতঞ্চ।
    বহ্নিং বক্ত্রং চন্দ্রসূর্যৌ চ নেত্রে
    দিশ: শ্রোত্রে ঘ্রাণমাহুশ্চ বায়ুম্।।
    বাচো বেদাংশ্চান্তরীক্ষং শরীরং
    ক্ষিতিং পাদৌ তারকা বোমকূপান্।।
    (বায়ু পু - ১/৯/৬৮)

    - শিবের উৎপত্তি অব্যাক্ত, তার দেহ ব্যাক্ত অর্থাৎ প্রকাশিত। তার দেহের অন্তর্গতসমূহ কাল। অগ্নি তাঁর মুখ, চন্দ্র ও সূর্য তার নেত্রদ্বয়, দিকসমূহ তাঁর কর্ণ, বায়ু তার ঘ্রাণ, বেদ তার বাক্য, অন্তরীক্ষ শরীর, পৃথিবী পদদ্বয়, তারকাগণ রোমকূপ।


    ১৩।বামন পূরাণে শিবের বিশ্বরূপ :
    ত্বমেব বিষ্ণুশ্চতুবাননতস্তৃং
    ত্বমেব মৃত্যুর্বদদস্তৃমেব।।
    ত্বমেব যজ্ঞো নিবমস্তমেব।
    ত্বমেব ভূতং ভবিতা ত্বমেব।।
    ত্বমেব সূর্যো রজনীকরশ্চ।
    ত্বমেব ভূমিঃ সলিলং ত্বমেব।
    স্থুলশ্চ সুক্ষ্মঃ পুরুষস্তৃমেব।।
    (বামন পু: ৫৪/৯৬-৯৯)
    - তুমিই বিষ্ণু,  তুমিই ব্রহ্মা, তুমিই মৃত্যু, তুমিই বরদ, তুমি সূর্য ও চন্দ্র, তুমি ভূমি, তুমি জল, তুমি যজ্ঞ, নিয়ম, তুমি অতীত, ভবিষ্যৎ, তুমি আদি ও অন্ত, তুমি সূক্ষ্ম ও স্থুল, তুমিই (বিরাট) পুরুষ।


    ১৪।পদ্মপুরাণে ব্রহ্মার বিশ্বরূপের বর্ণনা:
    বক্ত্রাণ্যনেকানি বিভো তবাহং
    পাশ্যামি যজ্ঞস্য গতিং পুরাণম্।
    ব্রহ্মাণমীশং জগতাং প্রসূতিং
    নমোহস্তু তুভ্যং প্রপিতামহায়।।
    ( পদ্মপুরাণ সৃষ্টি খণ্ড - ৩৪/১০০)

    হে বিভু, আমি দেখছি তোমার অনেক মুখ, তুমি যজ্ঞের গতি, তুমি পুরাণ পুরুষ, তুমি ব্রহ্মা, ঈশ, জগৎসমূহের সৃষ্টিকর্তা। প্রপিতামহ, তোমাকে নমস্কার।

    ১৫।গণেশ গীতাতে গণেশকে ব্রহ্মস্বরূপ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। গণেশ নিজের স্বরূপ বর্ণনা করছেন এভাবে:
    শিবে বিষ্ণৌ চ শক্তৌ চ সূর্যে মযি নরাধিপ।
    যা ভেদবুদ্ধির্যোগঃ স সম্যগ্ যোগো মতো মমো।।
    অহমেব জগৎ যস্মাৎ সৃজামি চ পালয়ামি চ।
    কৃত্বা নানাবিধিং বিষং সংহরামি স্বলীলয়া।।
    অহমেব মহাবিষ্ণুবহমেব সদাশিবঃ।
    অহমেব মহাশক্তিরহমেবার্ষিমা প্রিয়।।
    ( গণেশ গীতা - ১/২০-২২)

    - হে রাজন। শিব,  বিষ্ণু, শক্তি এবং সূর্যে যে ভেদবুদ্ধি সে আমারই সৃষ্টি, যেহেতু আমিই জগৎ সৃষ্টি করি, হে প্রিয়। আমিই মহা বিষ্ণু, আমিই সদাশিব, আমিই মহাশক্তি, আমিই অর্যমা।

    ১৬।মহাভারতের মার্কেণ্ডেয়-কৃত কার্তিকেয় স্তবে কার্তিকেয়ে বিশ্বমূর্তিরূপে বন্দিত হয়েছেনঃ
    ত্বং পুরস্করাক্ষরস্ত্বরবিন্দবক্ত্রঃ সহস্রবক্ত্রোহসি সহস্রবাহুঃ।
    ত্বং লোকপালঃ পরমং হবিশ্চ ত্বং ভাবনঃ সর্বসুরাসুরাণাম্।।
    ( মহাভাঃ বনপর্বঃ ২৩১, অঃ৪৩)
    -তুমি পদ্মপলাশলোচন, তুমি অরবিন্দতুল্যমুখ-বিশিষ্ট, তোমার সহস্র বদন,সহস্র বাহু, তুমি লোকপাল, শ্রেষ্ঠ হরি, সকল দেব ও অসুরগণের আবাধ্য।

    ১৭। কথিত আছে শ্রীরামকৃষ্ণ বিবেকানান্দকে ঈশ্বর দর্শণ করিয়েছিলেন। যেটাকে বিশ্বরূপ হিসেবে বিবেচনা করা যায়। (এটা গুজব হওয়াও অসম্ভব কিছু না)

    ১৮। লিঙ্গপুরাণ পূর্বভাগের ৩৬ তম অধ্যায়ে এরকম বর্ননা এসেছে। শ্রীবিষ্ণু ব্রাহ্মণবেশে দধীচি মুনির নিকট এসে বললেন - আমি আপনার নিকট বর প্রার্থনা করি আমাকে বর প্রদান করুন।  দধীচি মুনি বললেন রুদ্রদেবের অনুগ্রহে ভূত ভবিষ্যত আমি জানি।  আপনাকে আমি চিনিতে পারিয়াছি আপনি স্বরূপে ফিরে আসুন। আপনি কৃপা করে বলুন শিব আরাধনা পরায়ন ব্যক্তির কোন ভীতি থাকে?  আমি কাহারও সমীপে ভয় পাই না। তখন বিষ্ণু ছদ্মবেশ ত্যাগ করে বললেন - হে বিপ্র আমি জানি তুমি কাহারো নিকট ভয় পাও না তবুও তুমি সভামধ্যে ক্ষুপভূপতিকে বলো আমি ভয় পাইতেছি।  তখন মহামুনি বললেন আমি ভয় পাই না।  তখন বিষ্ণু ক্ষুব্ধ হইয়া মহামুনিকে চক্র উত্তোলন করে মারতে উদ্যত হলেন। তখন মুনির সহিত ভয়ানক যুদ্ধ বাধলো।  অতপরঃ বিষ্ণু  মুনির বিস্ময় সাধনার্থে বিশ্বমূর্তি ধারন করলেন

    ততো বিস্ময়নার্থায় বিশ্বমূর্তিরবূদ্ধরিঃ।
    তস্য দেহে হরেঃ সাক্ষাদপশ্যদ্বিজসত্তমঃ।।৫৮।।
    দধীচী ভগবান্বিপ্রঃ দেবতানাং গণনা পৃথক।
    রুদ্রাণাং কৌটয়শ্চৈব গণনাং কৌটয়স্তদা।।৫৯।।

    অনন্তর হরি মুনির বিস্ময় সাধনার্থে বিশ্বমূর্তি ধারন করলেন। মুনিবর ভগবান দধিচী নারায়ন শরীর মধ্যে পৃথক পৃথক দেবতা,  কোটি কোটি রুদ্র এবং কোটি কোটি ব্রহ্মান্ড অবলোকন করলেন।

    অতঃপর দধীচি মুনি মুনি বললেন -
    মায়াং ত্যজ মহাবাহো প্রতিভাসা বিচারতঃ।
    বিজ্ঞানানাং সহস্রাণি দুর্বিজ্ঞেয়াণি মাধবঃ।।৬২।।
     ময়ি পশ্য জগৎসবৈ ত্বয়া সাধমনিন্দিত।
    ব্রহ্মাণং চ তয়া রুদ্রং দিব্যাং দৃষ্টি দদামি তে।।৬৩।।

    হে মহাবাহো! বিচারপূর্বক প্রতিভা দ্বারা মায়া ত্যাগ করুন,  হে মাধব!  বিজ্ঞানসহস্র নিতান্ত দূর্বিজ্ঞেয়। হে অনিন্দিত! আমি তোমাকে দিব্যদৃষ্টি দান করিতেছি,  তুমি আমার শরীর মধ্যে তোমা সহ সমস্ত জগৎ ব্রহ্মা, রুদ্র এই সকল অবলোকন করো।

    ইত্যুক্তত্বা দর্শয়ামাস স্বতনৌ নিখিলং মুনিঃ।
    তং প্রাহু চ হরি দেবং সর্বদেবভবোদ্ভবম।।৬৪।।
    মায়য়া জ্ঞানয়া কিং বা মন্ত্রশক্তয়াথ বা প্রভো
    বস্ত শক্তয়াথ বা বিষ্ণো ধ্যানশক্তয়াথ বা পুনঃ।।৬৫।।
    ত্যক্ত মায়ামিমাং তস্মাদ্যোদ্ধর্মহসি যত্নতঃ।

    এই কথা বলিয়া দধিচী মুনি নিজ শরীররর মধ্যে সমস্ত জগৎ দর্শন করিয়া সর্বদেবজনক হরিকে বললেন - হে বিষ্ণো!  এই মায়া, মন্ত্রশক্তি দ্রব্য শক্তি ও ধ্যানশক্তিতে কি হইবে? অতএবঃ মায়া ত্যাগ করে যত্নপূর্বক যুদ্ধ করুন।

    শ্লোকগুলোতে দধীচি মুনি  বিশ্বরূপ কে মায়ার সাথে তুলোনা করেছেন  এমনকি তিনি নিজেও বিষ্ণুকে বিশ্বরূপ দেখিয়েছেন। অতঃএব বিশ্বরূপ প্রদর্শন একজন মুনির পক্ষেও সম্ভব। 



    এবার উপনিষদ হতে দেখে নেই 


    ছান্দোগ্য উপনিষদে সনৎকুমার তাঁর শিষ্য নারদকে বলেছেন-


    "....অহমেবাধস্তাদহমুপরিষ্টাদহং পশ্চাদহং পুরস্তাদহং দক্ষিণতোহহমুত্তরতোহহমেবেদং সর্বমিতি।।"


    ছান্দোগ্যোপনিষদ ৭।২৫।১.

    অর্থ: আমিই অধো ভাগে, আমি উর্ধ্বে, আমি পশ্চাতে, আমি সম্মূখে, আমি দক্ষিণে, আমি উত্তরে-আমিই এই সমস্ত।

    তাহলে এখানে সনৎকুমারকে ঈশ্বর হিসেবে মানতে হবে?

    আবার তৈত্তিরীয় উপনিষদে বলা হয়েছে –

    অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব। উর্ধ্বপবিত্রো বাজিনীব স্বমৃতমস্মি। দ্রবিণং সবর্চসম্। সুমেধা অমৃতোহক্ষিতঃ। ইতি ত্রিশঙ্কোর্বেদানুবচনম্।।

    তৈত্তিরীয় উপনিষদ– শীক্ষাবল্লী ১০ম অনুবাক।

    অর্থ: আমি সংসার বৃক্ষের উচ্ছেদক, আমার কীর্তি পর্বতের শিখরের মতো উন্নত। অন্নোৎপাদক শক্তিযুক্ত সূর্য যেরূপ অমৃতের মতো, আমিও সেরূপ। আমিই ধনের ভাণ্ডার, আমিই শ্রেষ্ঠ বুদ্ধিসম্পন্ন, আমিই অমৃত– এরূপ ঋষি ত্রিশঙ্কুর অনুভূত বৈদিক বচন।

    তাহলে এখানে ত্রিশঙ্কু ঋষিকে ঈশ্বর বলে গণ্য করতে হয়। তৈত্তিরীয় উপনিষদে আরও আছে–

    হা৩বু হা৩বু হা৩বু।

    অহমন্নমহমন্নমহমন্নম্। অহমন্নাদো৩হহমন্নাদো৩হহমন্নাদঃ। অহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃদহং শ্লোককৃহং শ্লোককৃৎ। অহমস্মি প্রথমজা ঋতা৩স্য। পূর্বং দেবেভ্যোহমৃতস্য না৩ভায়ি। যো মা দদাতি স ইদেব মা৩বাঃ। অহমন্নমন্নমদন্তমা৩দ্মি। অহং বিশ্বং ভুবনমভ্যভবা৩ম্।। সুবর্ণ জ্যোতীঃ য এবং বেদ।

    তৈত্তিরীয় উপনিষদ–ভৃগুবল্লী ১০ম অনুবাক।


    অর্থ: আশ্চর্য! আশ্চর্য! আশ্চর্য! আমি অন্ন, আমি অন্ন, আমি অন্ন। আমি অন্ন ভোক্তা, আমি অন্ন ভোক্তা, আমি অন্ন ভোক্তা। আমি সংযোগকারী, আমি সংযোগকারী, আমি সংযোগকারী। আমি সত্যের অর্থাৎ প্রতক্ষ্য জগত অপেক্ষা সর্ব প্রধান ও সর্ব প্রথম উৎপন্ন এবং দেবতাগণ হতেও পূর্বে বিদ্যমান অমৃতের কেন্দ্র হচ্ছি আমি। যে কেউ আমাকে অন্ন দেয় সে কার্য দ্বারা আমার রক্ষা করে। আমিই অন্নস্বরূপ হয়ে অন্ন ভক্ষণকর্তাকে ভক্ষণ করি। আমি সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডকে অভিভূত করি। আমার প্রকাশের এক ঝলক সূর্যের ন্যায়। যে এরূপ জানে সেও স্থিতি লাভ করে। 


    ১৯। পূরাণ উপনিষদ  থেকে তো অনেক উদাহরণ দিলাম। এবার বেদ দিয়ে শেষ করি। ঋগ্বেদ ৪/২৬/১-৩ খেয়াল করুনঃ

    এখন কি আপনারা ঋষি বামদেবকে ঈশ্বর বলে দাবি করবেন?



    ২০। অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।

    অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিন্যেভা।।


    ঋগবেদ ১০/১২৫/১

    অর্থ: আমি বাক্-আমব্রীনী, অসীম জ্ঞানের কন্ঠস্বর, মহাবিশ্বের বাক্, (আমি) ১১ রুদ্র, ৮ বসু, ১২ আদিত্য এবং সকল বিশ্বদেবগনের সহিত সকল কিছু বহনকারী ও একই সঙ্গে বিদ্যমান৷ আমি মিত্র ও বরুন (দিবস ও রাত্রি) উভয়ের সাথে ব্যাপ্ত ও ইহাদের ধারন করি৷ আমি ইন্দ্র ও অগ্নি (বাতাস ও আগুন) উভয়ের সহিত ব্যাপ্ত ও ইহাদের ধারন করি৷ আমি অশ্বিনীদ্বয়কে বহন করি ও ধারন করি৷


    এটি ঋগ্বেদের বিখ্যাত দেবী সূক্তের প্রথম মন্ত্র। যার দ্রষ্টা হচ্ছেন ঋষি অম্ভৃণের কন্যা বাক। এই সূক্তে ৮ টি মন্ত্র রয়েছে এবং প্রতিটিতেই আমি শব্দটি রয়েছে। ফলে এখানে "আমি" শব্দ দ্বারা মন্ত্রের বক্তাকেই ঈশ্বর মানলে ঋষিকা বাককে ঈশ্বর হিসেবে মানতে হবে।


    বেদ-পুরাণ ঘাটলে বিশ্বরূপের এমন আরো অজস্র উদাহরণ পাওয়া যাবে।

    সুতরাং বলা যায় শ্রীকৃষ্ণের বিশ্বরূপ প্রদর্শনেই প্রমাণ হয় না তিনি ঈশ্বর।